পাথরঘাটায় নোনা জলে সোনা ফলে
প্রথম জন যখন নিজের পতিত নোনা জমিতে সূর্যমুখী লাগিয়ে ছিলেন, পড়শিরা কটাক্ষ করে বলেছিলেন এ লোকের মাথাটা গিয়েছে। নইলে কেউ রবি মৌসুমে নোনা জমিতে সূর্যমুখী লাগায়। প্রথমবারই প্রথাগত চাষের বাইরে নোনা জলে সূর্ষমুখী চাষ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সূর্যের দিকে তাক করে থাকা হাসিমাখা সূর্যমুখী দেখতে ভীড় জমে যেতো। দ্বিতীয় জন যখন নোনা জমিতে (যে জমিতে কৃষিকাজ সাধারণত হয় না বা আদর্শ নয়) সূর্যমুখী চাষের পরিকল্পনার কথা কৃষি কর্মকর্তাদের শুনিয়েছিলেন, তাতে আশ্বস্ত হতে পারেননি কৃষি কর্মকর্তারাও। বলছিলেন, নোনা জলে ফসল পুড়ে যাবে।
প্রথম জন প্রায় ২০ বছর আগে ব্যাক্তি উদ্যোগে সূর্যমুখী চাষ শুরু হয়েছিল। এখনো চাষ করে যাচ্ছেন। তার দেখাদেখি অনেকেই এই চাষের দিকে ঝুকছেন। প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে এবার সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। বর্তমানে তার ক্ষেতে সূর্যমুখীর চাষ করে বছরে ১০০ লিটার তেল পাচ্ছেন। আর অন্য জন তার সেই নোনা জমিতেই সূর্যমুখী চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। প্রথম জন আবদুল হাকিম। চাকরি করেন কৃষি বিভাগে। কর্মরত আছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা সহকারি কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা পদে। দ্বিতীয় জন ফারুক সাজ্জাল। পেশায় প্রান্তিক কৃষক। দু’জনের বাড়ি পাথরঘাটার গহরপুর গ্রামে।
নোনা পানির দেশ
দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে বলেশ্বও আর পূর্বে বিষখালী নদী। সাগর ও নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। ভৌগলিক অবস্থান বলে দিচ্ছে উপজেলার তিন দিকেই পানি। তবে সেই পানি নোনা। লবনের কারনে এক সময় প্রায় ৬০ ভাগ জমি রবি মৌসুমে পতিত থাকত। কৃষি বিভাগ বলছে, পাথরঘাটা উপজেলার আয়তন ৩৮৭ দশমিক ৩৬ বর্গকিলোমিটার। উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়োতনের নোনা পানির নদ-নদী বয়ে গেছে। উপজেলায় কৃষি জমির পরিমান প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিশির কুমার বড়াল বলছেন, বোরো মৌসুমে ৬০ ভাগ কৃষি জমি শুধু লবনাক্ততার কারনে বছরের পর বছর পতিত থাকত। সিড়রের পর পতিত জমি চাষের আওতায় আসতে শুরু করে। তবে বছর পাঁচেক আগ থেকেই নোনা জলে কৃষকরা সোনা ফলাতে শুরু করেন। কৃষকরা মাটির উর্ভরতা বৃদ্ধকারী ফসল সূর্যমুখী, ডাল, মরিচ, ভুট্টা চাষে ঝুকে পড়েন। উপজেলার রুপদনে আলু চাষ হচ্ছে। ফলনের দিক বিবেচনায় আলু উৎপাদনে রুপদন দেশের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই ফসল লবনাক্ত জমিতে ভাল ফলন দিচ্ছে। সেচের ফলে মাটির লবনাক্ততা দিনদিন হৃাস পাচ্ছে। ফলে আমনের ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, রবি মৌসুমে লবনাক্ত জমিতে সূর্যমুখী চাষের ফলে সেচ দিতে হয়। সেচের ফলে জমির লবনাক্ততা হৃায় পায়। ফলে পরবতি বছর আমনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া সূর্যমুখী, ডাল, ভুট্টা লবন সহিষ্ণু ফসল।
কী ভাবে এগোলেন তাঁরা?
পাথরঘাটা উপজেলা সহকারি কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা আবদুল হাকিম বলছেন, সাগর তীরের এই উপজেলার ৮০ ভাগ লোকই মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কৃষি জমি যা আছে তাতে শুধু আমন ফলত। লবনাক্ততার কারনে এখানকার জমি বোরো মৌসুমে পতিত থাকত। পতিত জমিতে প্রায় ২০ বছর আগে প্রথম সূর্যমুখী চাষ করি। তখন পড়শিরা এ নিয়ে ঠাট্টা করত। যখন ভাল ফলন ধরলো, তখন শহরের লোকজন সূর্যমুখী বাগানে এসে ছবি তুলতো। শুধু সূর্যমুখী নয়, বোরো মৌসুমে মুগডাল চাষ শুরু করলাম। তাতেও অভাবনীয় ফসল পেলাম।
গহরপুর গ্রামের ফারুক সাজ্জাল বলছেন, সিড়রের পর সাগরে যেতে ভয় করত। ভাবলাম সাগরে না গিয়ে বোরো মৌসুমে ক্ষেতে চাষ দেই। কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তার বলছেন, লবনাক্ত জমিতে শষ্য দিলে পুড়ে যাবে। আবদুল হাকিম স্যারের সঙ্গে কথা বলে সূর্যমুখী চাষে উদ্ধুদ্ধ হই। প্রায় এক একর জমিতে এবার তিনি সূর্যমুখী চাষ করেছেন। গতবছর একই জমিতে চাষ করে যে তেল পেয়েছেন, তা বিক্রিতে লাভ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এবার সূর্যমুখীর ফল বড় হয়েছে। তেল বেশি পাবার সম্ভবনা রয়েছে।
খরচ কম, লাভ বেশি
কৃষি বিভাগ বলছে, উপজেলার এক শতাংশ জমিও এবারের বোরো মৌসুমে পতিত নেই। আবাদযোগ্য সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১১ হাজার ৫০০ হেক্টরে মুগডাল, ৫০০ হেক্টরে সূর্যমুখী আর বাকি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। যদিও বছর পাঁেচক আগে এই জমির ৬০ ভাগই লবনাক্ততার কারনে পতিত থাকত। সেই পতিত জমিতেই কোটি কোটি টাকার ফসল ফলছে।
রুপদনের কৃষকরা বলছেন, আলু চাষে সবচেয়ে লাভ বেশি। লাভের পাশাপাশি আলু চাষে ঝুকিও রয়েছে। তাছাড়া পাথরঘাটায় রুপদন ইউনিয়নের বাইরে তেমন আলুর চাষ হয় না। এক হেক্টর জমিতে আলু চাষ করে কৃষকরা এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। তারা বলছেন, এক হেক্টরে ৮০ হাজার টাকার আলু বীজ, সার ২৮ হাজার টাকার, ওষুধ সাড়ে ১১ হাজার টাকার। সব মিলিয়ে এক প্রতি এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
পাথরঘাটা ইউনিয়নের মুগডাল চাষীরা বলছেন, চাষ, সার আর বীজ মিলিয়ে হেক্টর প্রতি মুগডাল চাষে ব্যায় হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু হেক্টর প্রতি এক টন ডাল উৎপাদন হয়। ৭৫ টাকা কেজি দরে তা বিক্রি করলে হেক্টর প্রতি ৬০ হাজার টাকা লাভ হয়। তাছাড়া ডাল চাষে তেমন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। চাষাবাদ পদ্ধতিও সহজ। লবনাক্ত জমিতে ফলনও ভাল পাওয়া যায়। তাই কয়েক বছর ধরে ডালের আবার বাড়ছে।
সূর্যমুখী চাষিরা বলছেন, হেক্টর প্রতি চাষে ৬ হাজার ৭৫০ টাকা, সার ২২ হাজার ৭৫০ টাকা, বীজ বাবদ ৯ হাজার ৬০০ টাকা মিলিয়ে ৫৫ হাজার ৯০০ টাকায় ব্যায় হচ্ছে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে ২ হেক্টর। এই পরিমান বীজ থেকে তেল হচ্ছে ৮০০ কেজি। প্রতি কেজি সূর্যমুখী তেল বাজারে ১২০ দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই সিসেবে হেক্টর প্রতি লাভ হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা।
রফিকুল ইসলাম/বরিশাল/২৮ এপ্রিল