সুন্দরবনের বাঘ ৫০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হতে পারে
চোরা শিকারিদের উৎপাত আর শিল্পায়নের দূষণের পর এবার সুন্দরবনের বাঘের জন্য এক নতুন বিপদের কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বাঘের নতুন বিপদ হিসেবে এবার জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঘের বাসস্থান সুন্দরবনের বড় অংশ ডুবে যেতে পারে। এতে বিশেষত বাংলাদেশ অংশে বাঘ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ওই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শরীফ মুকুল। গবেষকেরা জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাসকে আমলে নিয়ে এই গবেষণা করেছেন। একই সঙ্গে এই পূর্বাভাসের প্রভাব বাঘের বসতি এলাকা সুন্দরবনে কতটুকু পড়বে, সেই হিসাবও করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে দুই ধরনের বিপদ বেশি বাড়বে। প্রথমত সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে সুন্দরবনের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যেতে পারে। বাঘ মূলত ওই এলাকাগুলোতেই বেশি বসবাস ও বিচরণ করে থাকে। এতে বাঘ আর সেখানে থাকতে পারবে না। দ্বিতীয়ত সুন্দরবন এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার ফলে গাছের ধরনের বদল হবে। যেমন সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ কমে গিয়ে কেওড়া ও গেওয়াগাছের পরিমাণ বেড়ে যাবে, যা বাঘের বসবাসের পরিবেশ নষ্ট করবে।
তবে বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুন্দরবনের বাঘের জন্য দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া বড় হুমকি। একই সঙ্গে বর্তমানে চোরা শিকারিদের হাতে বাঘ শিকার ও সুন্দরবনের পাশের শিল্পায়নকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে মনে করেছেন তাঁরা। আর ঐতিহাসিকভাবে সুন্দরবন একটি সক্রিয় বদ্বীপ এলাকা। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে এর সঙ্গে আসা পলির কারণে এই বন আরও উঁচু হতে পারে। তাই সাধারণ একটি ভূখণ্ড যেভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ডুবে যাওয়ার হুমকিতে থাকে, সুন্দরবনের জন্য সেই হুমকি ততটা নেই। তবে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকে তাঁরা হুমকি হিসেবেই মনে করেন।
গবেষণাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত শরীফ মুকুল বলেন, সুন্দরবনের চারপাশে শিল্পকারখানার চাপ বাড়ছে। সেখানে সড়ক নির্মাণ হচ্ছে এবং চোরা শিকারিদের দাপট বাড়ছে। এতে বাঘের বসতি এলাকার বিপদও বাড়ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ যোগ হয়ে তা আরও বড় বিপদের দিকে বাঘকে ঢেলে দিচ্ছে। তবে বাঘ রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ বাড়ালে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে বাঘকে টিকে থাকতে সহায়তা করলে তা বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০। ২০১০ সালে রাশিয়ায় বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। এই লক্ষ্যে গঠিত হয় গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ (জিটিআই)। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশও বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, বাঘের জন্য সুন্দরবন এমনিতেই প্রতিকূল পরিবেশ। বেঙ্গল টাইগার এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে। তবে সুন্দরবনের চারপাশে যেভাবে শিল্পকারখানা হচ্ছে ও দূষণ বাড়ছে, তাতে বাঘের জন্য বিপদ তৈরি হচ্ছে।
এ ছাড়া খাদ্যসংকটের কারণে বাঘ বসতি এলাকায় চলে আসছে, এতে মানুষের হাতে বাঘ মারা পড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেলে বাঘের বন থেকে লোকালয়ে আসার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। তবে বাঘের আশু বিপদ হিসেবে অবশ্যই চোরা শিকার ও শিল্পদূষণ সবচেয়ে ভয়ংকর। সরকারকে বাঘ রক্ষা করতে হলে এই সব কটি বিপদকে আমলে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/১৫ ফেব্রুয়ারি