ঘূর্ণিঝড় সিডরের ভয়াল স্মৃতিবিজড়িত ১৫ নভেম্বর আজ

ইতিহাসের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক ধ্বসলীলার দিন আজ ১৫ নভেম্বর ‘সিডর দিবস’। সিডরে কালো রাত্রির ভয়াল দূর্যোগ গোটা উপকুলবাসীকে আজো তাড়া করে ফিরছে।
আজও উপকুলের বিভিন্ন জনপদে কান পাতলে শোনা যায় স্বজনহারাদের দীর্ঘশ্বাস। আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতে ভরা জোয়ারে ভড় করে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বলেশ্বর নদী মোহনা হয়ে উপকুলের ১০টি জেলার জনপদে হামলে পরে। পর্যাপ্ত প্রাক-সতর্কতার কারণে ইতিহাসের ভয়াবহতম ঐ ঘূর্ণিঝরে প্রাণহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদ-এর ক্ষতি ছিল কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝর সিডরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয় উপকুলের ১০টি জেলায়। যার সিংহভাগই ছিল পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও বরিশালে।
তবে বেসরকারী সূত্রের মতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল কুড়ি হাজার কোটি টাকা। আর প্রাণহানী ঘটে ৩ সহস্রাধীক মানুষের। নিখোঁজের ছিল আরো সহস্রাধীক। যাদের প্রায় সকলেরই আর কোন হদিস মেলেনি পরবর্তীতে।
একের পর এক প্রকৃতিক বিপর্যয়ে উপক‚লীয় জনপদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আজো অনেক পেছনে। স্মরনাতীতকাল থেকে উপকুলীয় জনপদের মানুষকে প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে। বারবারই বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়সহ গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা উপকুলীয় জনপদকে বিপন্ন করছে।
ইতিহাসের এমনকি এক ভয়াবহ বিপর্যয় ছিল ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতের ঘূর্ণিঝর ‘সিডর’। ২০০৭-এর ১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় আবহাওয়া অধিদফতর দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি লঘুচাপ সনাক্ত করে। লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশ উপকুলের ৫শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙ্গা উপকূলে অগ্রসর হচ্ছিল। উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚লের মাত্র ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসলেও আকষ্মিকভাবেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকুলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রমের পরিবর্তে গতিপথ পরিবর্তন করে ঘূর্ণিঝড়টি উত্তরমুখি থেকে উত্তর-পূর্বমুখি হতে শুরু করে। সিডর সন্ধ্যা ৬টার পরেই অতি দ্রুত গতিতে উত্তর-পূর্বমুখি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে শুরু করে। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ ছিল অনেক লম্বা। সে রাতে সাগরপাাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দুরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড়-সিডর’র তীব্রতা ছিল সোয়া ২শ’ কিলোমিটার। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে পিরোজপুর-ঝালকাঠী বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল।
একইভাবে ঝরটি পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার পশ্চিমভাগেও আঘাত হানে। প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঐ ঝড়ের সাথে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপক‚লের বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
সেদিন ভয়াবহ ঐ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকুলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়নে ক্ষতি ছিল সর্বাধীক। সরকারী হিসেবে ক্ষতিগস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ধরা হলেও বেসরকারী মতে তা ছিল অন্তত ২০ লাখ। আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় পৌনে এক কোটি। সরকারীভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজ হবার কথা বলা হলেও এসংখ্যাও আরো অনেক বেশী বলে মনে করা হয়। বেশীরভাগ নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান না মেলায় তাদের সকলকেই সিডরের বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারী হিসেবে ১৫ নভেম্বর সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপক‚লের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একই সাথে প্রায় প্রায় ২লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টর আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের কালো থাবায়।
এছাড়াও প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড় ৬হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেতু ও কলাভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও ছিল উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১ হাজার ৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ এবং অঅরো প্রায় ৯শ’টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সিডরের সে ধ্বংসলীলা এখনো গোটা উপকুলবাসীকে তারা করে।
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/১৫ নভেম্বর