মহররমের মর্যাদা ও আমল ?
আশুরা উপলক্ষে দুই দিন রোজা রাখতে হয়। মহররমের ১০ তারিখের আগে বা পরে এক দিন বাড়িয়ে রোজা রাখা মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখ। তবে এক্ষেত্রে ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বন করে আশুরার আগে অথবা পরের একদিনসহ রোজা রাখবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৪১)
আরবি ‘শাহর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মাস, আর ‘মহররম’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। সুতরাং ‘শাহরুল মহররম’ এর যৌগিক অর্থ হলো ‘সম্মানিত মাস। মহররম হলো হিজরি সনের প্রথম মাস। মহান আল্লাহ তায়ালা যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো মহররম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬)।
এ মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। আরবি ‘আশারা’ শব্দ থেকে এর উৎখলন। যার অর্থ হচ্ছে দশ। তাই এ মাসের ১০ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলে অবহিত করা হয়। ইসলামি শরিয়তে এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এ দিনে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। হাদিসে এসেছেÑ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাউহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ মহররম তথা পবিত্র আশুরার দিবস। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমাবারে হজরত ইসরাফিল (আ.) এর ফুঁৎকারে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কেয়ামত।
এছাড়াও ইসলামের আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এ আশুরার দিনেই। যেমনÑ আদি পিতা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয় এ দিনে, এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় আবার ভুলের কারণে পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তার তওবা কবুল করা হয়। এভাবে এ দিনে জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন, আবার এ দিনেই নমরুদের বিশাল অগ্নিকু- থেকে মুক্তিলাভ করেন। এই আশুরাতেই তুর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে মুসা (আ.) কথোপকথন ও আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ লাভ করেন, আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা, সর্বশেষ কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে হুসাইন (রা.) এর নির্মমভাবে শাহাদতবরণÑ এসব কিছুই সংঘটিত হয়েছে ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরার দিনে। মোটকথা এ ১০ মহররম যেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে এ দিনটির রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বহু বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট আমল হলো ‘আশুরার সিয়াম’।
আশুরা উপলক্ষে দুই দিন রোজা রাখতে হয়। মহররমের ১০ তারিখের আগে বা পরে এক দিন বাড়িয়ে রোজা রাখা মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখ। তবে এক্ষেত্রে ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বন করে আশুরার আগে অথবা পরের একদিনসহ রোজা রাখবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৪১)।
এ রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, একবার হজরত আলী (রা.) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে কি, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন। আলী (রা.) বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছেও এক সাহাবি করেছিলেন। তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর তুমি যদি রোজা রাখতে চাও, তাহলে মহররম মাসে রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (তিরিমিজি : ১১৫৭)।
মুসনাদে হুমাইদিতে এসেছে, আবু কাতাদাহ (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আরাফার দিনের রোজা এ বছর ও আগামী বছরের পাপের কাফফারা হবে। আর আশুরার রোজা এক বছরের পাপের কাফফারা হবে।’ (হুমাইদি : ৪৩৩)।
আশুরার রোজা একসময় ফরজ ছিল। পরে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর তা রহিত হয়ে গেছে। তখন থেকে আশুরার দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। সহিহ মুসলিম শরিফে এসেছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কোরাইশরা জাহেলি যুগে আশুরার দিন রোজা রাখত। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) সেদিন রোজা রাখতেন, যখন তিনি মদিনায় হিজরত করেন, তখন থেকে। তিনি নিজে রোজা রাখেন ও সাহাবাদের রোজা রাখার নির্দেশ দেন।’ অতঃপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন তিনি বললেন, ‘যার ইচ্ছা (১০ মহররমের) রোজা রাখো, আর যার ইচ্ছা রোজা রাখবে না।’ (মুসলিম : ১১২৫)।
হজরত জাবের (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত আছে, ‘রাসুল (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবর নিতেন না।’ (মুসলিম : ১১২৮)।
এই দিন বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করাও একটি বিশেষ আমল। কারণ নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘মহররম হলো আল্লাহ তায়ালার কাছে একটি মর্যাদাবান মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি : ৭৪১)।
ওপরে উল্লিখিত নফল আমলগুলো ছাড়া কিছু বেদাত আশুরার দিনে সমাজে প্রচলিত রয়েছে, যা থেকে বিরত থাকা প্রকৃত মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। যেমনÑ তাজিয়া বানানো। অর্থাৎ হুসাইন (রা.) এর নকল কবর বানানো। কিছু বেদাতি মানুষ এদিন নানা রকমের পতাকা ও ব্যানার টানিয়ে মিছিল করে, যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৫/২৯৪)।
এছাড়া ‘হায় হুসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা ইত্যাদিও বেদাত।
সবাইকে শেয়ার করুন