সুন্দরবন সহ জলদস্যু ও আন্ডারওয়ার্ল্ডে অস্ত্র যাচ্ছে যেভাবে
জলদস্যু ও বনদস্যুসহ দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাছে অভিনব উপায়ে পৌঁছে যাচ্ছে অস্ত্র। একশ্রেণির বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী অবৈধ পন্থায় হাতবদল করে অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছেন দাগী সন্ত্রাসীদের। বিশেষ করে লাইসেন্স করা একনলা ও দোনলা বন্দুক কৌশলে মূল মালিকপক্ষের কাছ থেকে নিয়ে অর্থের বিনিময়ে সুন্দরবনের জলদস্যুদের দেওয়া হচ্ছে। যারা এ চক্রে জড়িত তাদের মধ্যে কয়েকজনকে এরই মধ্যে শনাক্ত করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বৈধ অস্ত্রের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে দেশে ডিজিটালাইজেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বৈধ কোনো অস্ত্র কোথায় কীভাবে কার হাতে রয়েছে তা অনেক ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব হয় না। অনেকে এই সুযোগে বৈধ অস্ত্রের চিহ্নিতকরণ নম্বর ঘষামাজা করে অবৈধভাবে হাতবদল করে দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিটিসির এডিসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী অবৈধভাবে অস্ত্রের হাতবদল করে সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বৈধ অস্ত্রের সঠিক হিসাব রাখার জন্য ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই, যাতে দেশের কোনো জায়গায় একটি অস্ত্র জব্দ করা হলে তা বৈধ না অবৈধ তা তাৎক্ষণিকভাবে বের করা যায়।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, এখন দেশে একনলা ও দোনলা বন্দুকের কোনো চাহিদা নেই। তাই যারা পৈতৃক সূত্রে এ ধরনের অস্ত্র পেয়েছেন, তারাও রয়েছেন বিপাকে। কারণ কোনো কাজে তা না লাগালেও প্রতিবছর নতুনভাবে এসব অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। অনেকে তাই অস্ত্রের বৈধ ব্যবসায়ীদের কাছে একনলা ও দোনলা বন্দুক বিক্রির জন্য নিয়ে যান।
তখন ব্যবসায়ীরা অস্ত্রের মালিকদের জানান, এসব অস্ত্রের কোনো চাহিদা নেই। বিক্রি তো দূরের কথা একনলা ও দোনলা বন্দুক তাদের কাছে রাখার বিনিময়ে অর্থও দাবি করেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে একনলা ও দোনলা বন্দুক রেখে যান। পরে বৈধ দোকান মালিকরা অবৈধভাবে এসব অস্ত্র ৩০-৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে সুন্দরবনের জলদস্যু ও বনদস্যুদের হাতে তুলে দেন। যেসব অস্ত্র ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন খুলনার বৈধ অস্ত্রের ডিলার সুবোধ বধি অ্যালবার্ট ও নেত্রকোনা আর্মস কোম্পানির কর্ণধার মোহাম্মদ আলী বাবুল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনের মাস্টার বাহিনীর ১০ সদস্য আত্মসমর্পণ করে ও তারা ৫২টি অস্ত্র এবং তিন হাজার ৯০৪ রাউন্ড গুলি জমা দেয়। এ ছাড়া মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর ২৫টি অস্ত্র, শান্ত ও আলম বাহিনীর ২০টি, খোকা বাবু বাহিনীর ২২টি, নোয়া বাহিনীর ২৫টি, জাহাঙ্গীর বাহিনীর ৩১টি, ছোট রাজু বাহিনীর ২১টি, আলিফ ও কবিরাজ বাহিনীর ৩১টি, মানজু বাহিনীর ১৯টি, মজিদ বাহিনীর ১৪টি, বড় ভাই বাহিনীর ১৮টি, ভাই ভাই বাহিনীর ৮টি, সুমন বাহিনীর ১২টি, ডন বাহিনীর ১০টি, ছোট জাহাঙ্গীর বাহিনীর ৯টি, ছোট সুমন বাহিনীর ৯টি, দাদা ভাই বাহিনীর ১২টি, হান্নান বাহিনীর ৮টি, আমির আলী বাহিনীর ৫টি, সূর্য বাহিনীর ১১টি, ছোট সামসু বাহিনীর ১০টি ও মুন্না বাহিনীর ১২টি অস্ত্রসহ মোট ৪০৪টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র র্যাবের কাছে জমা দেওয়া হয়।
পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরই তারা বিভিন্ন ধরনের ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও আড়াই হাজারের বেশি গুলি উদ্ধার করেছেন। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ১০ অস্ত্র কারবারিকেও। এ বছরের ১ এপ্রিল রংপুরের সরকার আর্মস কোম্পানির কর্ণধার আনোয়ার হোসেন বাবু অবৈধভাবে দুটি অস্ত্র বিক্রি করতে রাজধানীর গাবতলী আসেন। ওই সময় পুলিশ এক সহযোগীসহ বাবুকে গ্রেফতার করে। তখন জানা যায়, রাজশাহীর এক বৈধ অস্ত্রের ডিলার ও একজন নারীর কাছ থেকে বৈধভাবে ওই দুটি অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন তিনি। এরপর অবৈধভাবে তা বিক্রি করতে গাবতলী নিয়ে আসেন।
পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেফতার করে নেত্রকোনা আর্মস কোম্পানির কর্ণধার মোহাম্মদ আলী বাবুল, ডা. জাহিদুল আলম ও আনোয়ার হোসেন বাবুসহ অন্তত ১০ জনকে। বাবুলের কাছ থেকে একটি পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল, চারটি একনলা বন্দুক, দুটি পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল, একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ বোরের পিস্তল ও দুটি পয়েন্ট ৩২ বোরের রিভলবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডা. জাহিদুলের ময়মনসিংহের ফ্ল্যাট থেকে আরও ১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার ৬২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে কয়েকজন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর অবৈধ অস্ত্রের কারবারের বিষয়টি। এর পরই চলতি বছরের ১১ জুন মোহাম্মদ আলী বাবুলকে বৈধ কাগজপত্রহীন একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ১২৫ রাউন্ড গুলিসহ মহাখালী থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, ডা. জাহিদুল চিকিৎসা পেশার আড়ালে বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধভাবে বিদেশি অস্ত্র সংগ্রহ করতেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাছে বিক্রি করতেন সেই অস্ত্র। পেশাদার কিলার হিসেবে একজনকে হত্যার ছক কষছিলেন তিনি। তার আগেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে তার সঙ্গে পেশাদার অপরাধীদের সখ্যের প্রমাণ মিলেছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরই বাড্ডায় একের পর এক কয়েকটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২২ এপ্রিল রাজধানীর বাড্ডা থানা এলাকার বেরাইদে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে কামরুজ্জামান দুখু মিয়া নামে একজন নিহত হন। গত ৯ মে ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবুকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসব কিলিং মিশনে জড়িতরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তদন্তে উঠে এসেছে, বিদেশে বসেই ইশারায় বাড্ডায় খুনোখুনি করাচ্ছে একটি চক্র। বিদেশে থেকে যারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য হিসেবে সক্রিয়, তাদের মধ্যে রয়েছে সাফায়েত তানভীর রনি, হেলাল, শুভ, হাশেম, ইদ্রিস, রাসেল, মামুন, ইশন।
তাদের হয়ে ঢাকায় যারা খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে, তাদের সবার হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন যাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে তারা হলো- মাসুম, আরিফ, নূরী, সাদ্দাম, নূরা, পিচ্চি আলামিন, জাকির, হেলাল ও বাদশা। এ ছাড়া পাহাড়েও অনেক সন্ত্রাসীর হাতে রয়েছে অস্ত্র। এমনকি উগ্রপন্থিদের কাছেও আছে। কখনও কখনও অনেক রাজনৈতিক দলের ক্যাডারের হাতে অস্ত্রের দেখা মেলে। এমনকি ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্রের সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে অপারেশনে যায়। এসব অস্ত্র কীভাবে কার কাছ থেকে অপরাধীরা পাচ্ছে- সেটা জানা এবং সেই পথ বন্ধ করাই এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় চ্যালেঞ্জ।