সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল
শফিকুল ইসলাম খোকন
সড়ক বা নৌদুর্ঘটনা নিয়ে অনেক লিখেছি। এত লেখালেখি এবং বিদ্যমান আইন থাকা সত্ত্বেও সড়ক ও নৌদুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না। আমরা অবশ্যই ভুলে যাইনি মিশুক-মুনিরের কথা, ভুলে যাইনি চট্টগ্রামের বাস দুর্ঘটনায় শিশুদের মৃত্যু, ভুলে যাইনি রোজিনা, নুসরাত রাজীবের কথা। একটি জীবনের মৃত্যু সারা জীবনের কান্না। মৃত্যু, মৃত্যুই। সে মৃত্যু একটি বা একাধিক জীবন হোক। যার স্বজন মারা যায় সেই কেবল বুঝে স্বজন হারার বেদনা। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে মানুষ হাসে, ঘটনার পরম্পরায় মানুষ কাঁদে। লাশের সামনে, নির্মম হত্যাকা-ে নিহতের সংবাদে মানুষ শোককাতর হয়। নির্বাক হয়। অশ্রুসজল হয়। এটাই মানুষের মানবিক চরিত্র, এটাই নিয়ম। দুর্ঘটনার রোজিনা, নুসরাত, রাজীবের মৃত্যুতে সারা দেশ যেমন কেঁদেছে, ঠিক এখনো কাঁদছে জাবালে নুর পরিবহনে পিষ্ট হওয়া শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও রেজাউল করিম রাজুর নির্মম মৃত্যুতে। সারা দেশ আজ স্তব্দ।
সারা দেশের মতো রাজধানীতে একের পর এক দুর্ঘটনা সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সব দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলার সুযোগ আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে দুর্ঘটনার জন্য সিংহভাগ দায়ী চালক, সেই দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সেটিকে কেউ দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকা- বললে কি অযৌক্তিক হবে? যাত্রী তোলার জন্য দুটি বাসের রেষারেষির শিকার হয়েছে তারা। এ ঘটনাকে কি আমরা দুর্ঘটনা বলব? না হত্যাকা- বলব? সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের নৈরাজ্যের শিকার হয়ে আরো কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে দুটি বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের এক হাত বিচ্ছিন্ন এবং পরে তার করুণ মৃত্যুর ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। এ ঘটনা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই যেন রাজধানীর রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এত দুর্ঘটনা কেন, এ প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক নয়। রাজধানীতে দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা অতীতে খুব বেশি ঘটেনি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সেই ঘটনাই ঘটছে অহরহ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর মতো রাজধানীতেও সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি সবার জন্যই উদ্বেগজনক। ইতোমধ্যেই বাসমালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, চালক ও হেলপারকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কী হবে? কিছুই হবে না। কয়েকদিন পরে জামিনে এসে যাবে। কিন্তু তাদের ভুলের কারণে দুটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল।
রাজীব গেলেন, রোজিনা এসে ৯ দিন পর চলে গেলেন, রাসেলের পর ঝুমা, ঝুমার পরে দিয়া আক্তার মিম ও রাজু। তাদের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে, এ রকমে প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এভাবে ‘যাতায়াত’ চলতেই থাকবে আর বহাল তবিয়তে থেকে যাবে নৈরাজ্য ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা! তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের কথা এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে রয়েছে। প্রত্যেক বাবা-মায়েরই ইচ্ছা থাকে, সন্তান পড়াশোনা শেষে চাকরি করবেÑহাল ধরবে পরিবারের। চিরাচরিত এ স্বপ্নের কাছাকাছি যাওয়ার আগেই চলে যেতে হলো রাজীব, দিয়া আক্তার মিম ও আবদুল করিমকে। এভাবে ‘মাঠ গরম’ রাখার জন্য চটজলদি যেন সিরিয়াল দেওয়া রয়েছে। এ যেন মৃত্যু ও শোকের মিছিল। রোজিনার চলে যাওয়াকে ভুলতে সাধারণ মানুষের সময় লাগবে। একজন নারী হয়ে তিনি হাল ধরেছিলেন সংসারের। চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, বিধ্বস্ত সংসারকে শ্রী দেওয়ার। এসব মৃত্যু কি আমরা সাধারণ মৃত্যু বলব, না হত্যাকা-! এসব মৃত্যু অস্বাভাবিক, এসব মৃত্যু কখনোই স্বাভাবিক বলা যাবে না। আমাদের দেশে এটিকে কখনোই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নেওয়া যায় না। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না আর হবেও না। দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে?
সরকারি হিসাব মতে, ১৯৯৯ সালে ৪ হাজার ৯১৬, ২০০০ সালে ৪ হাজার ৩৫৭, ২০০১ সালে ৪ হাজার ৯১, ২০০২ সালে ৪ হাজার ৯১৮, ২০০৩ সালে ৪ হাজার ৭ ৪৯, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৮২৮, ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৪, ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪, ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৮৬৯, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৪২৬, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ২৯৭, ২০১০ সালে ৫ হাজার ৮০৩, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৬৮৮, ২০১২ সালে ৫ হাজার ৯১১, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৮৬৫ এবং ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৯৭৫, ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৬৪২, ২০১৬ সালে ৭ হাজার ৪২৭, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০১৮ সালে চলতি জুন পর্যন্ত হিসেবে বিগত বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ জনের বেশি মানুষ। প্রতি বছরই এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে আর তা রোধ করা যাচ্ছে না কেন? অদক্ষ ও দুই নম্বরী লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকরাই যে এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিকার কেউ করছে না। সড়কে এখন নৈরাজ্য চলছে। এ নৈরাজ্য থামাবে কে? বিদ্যমান আইনের কোনো বাস্তবায়ন হয় না। চালক নামের ঘাতকদের রোধ ও পরিবহনব্যবস্থার নৈরাজ্য ঠেকাতে না পারলে আমরা কেউই নিরাপদ থাকব না। ঘাতকরা যেকোনো সময় চাপা দিয়ে প্রাণটা কেড়ে নেবে।
সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মোংলা বন্দরের জন্য একটি মোবাইল হারবার ক্রেন ক্রয়ের বিষয়ে চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শাজাহান খান বলেন, ‘ভারতের মহারাষ্ট্রে এক দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছে, তা নিয়ে কোনো হইচই নেই। অথচ বাংলাদেশে সামান্য কোনো ঘটনা ঘটলেই হইচই শুরু হয়ে যায়।’ ভারতের সঙ্গে তুলনা করে কী লাভ। ভারতে পরিবহন সেক্টরে আমাদের মতো এমন নৈরাজ্য নেই। ভারতে কি প্রতিদিন এত মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়? নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের এ উক্তিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বস্তরে বিতর্কিত হয়। তবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে আরো সংযত হয়ে কথা বলার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার বিব্রত হয় এমন যেকোনো মন্তব্য পরিহার করতে হবে। কথা বলার সময় আরো সতর্ক থাকতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ না করে মহারাষ্ট্রের সড়ক দুর্ঘটনার রেফারেন্স দেওয়া ঠিক হয়নি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য যৌক্তিক ও প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু রাজু-দিয়ার এমন হৃদয়বিদারক সড়ক হত্যাকা-ের পর আপনার হাসি ও বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ শুধু নয়, ক্ষমাও চেয়েছেন, এক অনুষ্ঠানে লজ্জিত হয়েছেন। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ তাদের প্রতিবাদী অবস্থান থেকে যখন ক্ষমা চাইতে বলেছে, আপনি তখন ক্ষমা চেয়েছেন। এতে আত্মশুদ্ধির মহত্ত আছে। লজ্জার কিছু নেই। একই সঙ্গে আপনার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলেই জবাব পেয়ে যাবেন, কখন হাসতে হয়, কখন কাঁদতে হয়, কখন বিষাদগ্রস্ত হতে হয়। আপনার কথায় সারা দেশের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। এখন কি আপনার মতো মন্ত্রীর কথার অনুসরণ করবে? অনুসরণ করতে হলো বলতেই হবে, ‘শোকে কাঁদতে নেই’।
পরিশেষে বলতে চাই, একেকটি ইস্যু আসে একেকটি ইস্যু যায়। একেকটি ঘটনা আসে ঝড় তুলে আরেক ঘটনায় তা তামাদি হয়ে যায়। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি ইস্যু এলো আর গেল। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা চুরি, সিটি নির্বাচন, এরপর সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই শাজাহান খানের হাসি, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা। এরপর কোনো ইস্যু অপেক্ষা করছে জানি না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার অর্থ কি আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়া নয় তো? তবে ইস্যু একের পর এক যাই আসুক না কে? যে বাবা-মা সন্তানকে হারিয়েছে, তারা আর সন্তান ফিরে পাবে না। রাজু আর দিয়ার মতো অনেক প্রাণ হারিয়েছে, তাদের বাবা-মায়ের মতো এ কান্না দেশের লাখো সন্তানের মা-বাবারই কান্না। সব মানুষের আকুতি একটাই নিরাপদ সড়ক চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। সড়ক-মহাসড়কে নৃশংস হত্যাকা- যেমন দেখতে চাই না, তেমনি কোনো মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদের মুখে নির্দয় হাসি আর অপরাধীকে রক্ষার বক্তব্যও শুনতে চাই না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
msi.khokonp@gmail.com
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৪ আগস্ট