কী দরকার এই ‘নির্বাচন নির্বাচন’ খেলার?
দেশজুড়ে নির্বাচনের আবহ। তিন সিটি কর্পোরেশনে নগরপিতা বাছাইয়ের ভোট হয়েছে আজ। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে, প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়েছেন মাসব্যাপী, সেখানেও টাকার ছড়াছড়ি কম হয়নি। কিন্ত আসলেই কি এই ‘নির্বাচন নির্বাচন’ খেলার দরকার আছে কোন? নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি হয়নি, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্ত এমন নির্বাচনের লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতাটা করার কি খুব প্রয়োজন? যারা জেতার, তারাই জিতেছে, যাদের ক্ষমতা আছে, তারাই পদে বসছে তাহলে মাঝখান দিয়ে এতগুলো টাকা আর সময়ের অপচয়টা কেন করা?
‘শান্তিপূর্ণ’ আর ‘উৎসবমুখর পরিবেশে’ নাকি তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, আওয়ামীলীগের নেতারা এমনটাই দাবী করেছেন। বিএনপির দাবী, ভোট ডাকাতি করেছে সরকারী দল! কার কথা বিশ্বাস করা যায়? মিডিয়া বলছে, শান্তিপূর্ণ আবহটা বেশিরভাগ জায়গাতেই বজায় ছিল না। উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল, তবে সেটা নির্দিষ্ট একটা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই। রাজশাহী-বরিশাল-সিলেট, সব জায়গা থেকেই খবর এসেছে বিশৃঙখলার, জালভোটও পড়েছে অজস্র। কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা তো ডালভাত হয়ে গেছে। এগুলো যে হবে, সেটা আমরা জানতাম, যারা নির্বাচনের আয়োজন করেছেন তারাও জানতেন। তাহলে এই ফালতু আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন কেন? লোক দেখানো গণতন্ত্র রক্ষার জন্যে?
বরিশাল দিয়েই শুরু করা যাক। এখানকার বিএনপি প্রার্থী সকালেই দারুণ বিনোদন উপহার দিয়েছেন। মজিবর রহমান সরওয়ার নামের এই ভদ্রলোক সকালে ভোট দিতে গিয়েছেন সৈয়দা মজিদুন্নেসা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। তিনি একজন প্রার্থী, একজন ভোটার, অথচ নিজের ভোটার নাম্বার তার জানা নেই! ভোট দিতে যে ভোটার নাম্বার দরকার হয়, সেটাও জানতেন না বোধহয় তিনি! এই টাইপের মূর্খ মানুষগুলোই আমাদের নেতা হয়, এটাই আফসোসের বিষয়। এই কেন্দ্রেই দুপুরের দিকে ভোট কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে, আওয়ামীলীগের লোকজন কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে নৌকা প্রতীকে গণহারে সিল মেরে সিল আর প্যাড নিয়ে গেছে- এমন অভিযোগে ভোট বাতিল করে দেন প্রিজাইডিং অফিসার।
বরিশালে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন বাসদের ডা. মনীষা চক্রবর্তী। বরিশালের ইতিহাসে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রথম নারী প্রার্থী তিনি। প্রচারণার সময়েই দারুণ আলোচনায় এসেছিলেন এই তরুণী। স্পষ্টভাষী আর শিক্ষিত এই তরুণীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সবাই। এমনকি আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, মনীষাকে তারা স্বাগত জানাচ্ছে, এমনকি এটাও বলা হয়েছিল, তাকে যেন কোন রকমের অসুবিধার মধ্যে ফেলা না হয়, নারী বলে মনীষা চক্রবর্তীকে যেন বিন্দুমাত্র অসম্মান করা না হয়।
কিন্ত সদর গার্লজ স্কুল কেন্দ্রে তাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন আওয়ামীলীগের কয়েকজন কর্মী। পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন মনীষা। শেষমেশ নির্বাচন বর্জন করেছেন তিনি। ভোটে মনীষা হয়তো এমনিতেই জিততেন না, তবুও কেন তার গায়ে হাত তোলা? বরিশালে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থীও। তবে নির্বাচন বর্জন করাটা বিএনপির জন্যে অনেকটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে মেয়র প্রার্থী ভোটার নম্বর সম্পর্কেই অবগত নন, তিনি ভোটের মাঠে থাকলে যা, না থাকলেও তা।
সিলেটে অন্তত পনেরোটি কেন্দ্রে জালভোট গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিএনপি বা অন্যান্য দলের পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, দুই-এক জায়গায় মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। খাস দবির প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার ঘটনাও ঘটেছে। জালভোটের অভিযোগ উঠেছে আরও বেশকিছু কেন্দ্রে। কয়েক জায়গা থেকে সাংবাদিকদেরও হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এসেছে। তবে এখানে নির্বাচন বয়কট করেনি বিএনপি।
সিলেটের নবীনচন্দ্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে ছিল ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। কিন্ত ভেতরে ছিল না ব্যালট পেপার। ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে, এমন যুক্তি দিয়ে অলস বসেছিলেন প্রিজাইডিং অফিসার আর অন্যান্য কর্মচারীরা। অথচ বাইরে তখন অপেক্ষায় ভোটারেরা! তাহলে তাদের ভোটটা দিলো কে? বেশকিছু কেন্দ্রে দুপুরের আগেই ভোটগ্রহন শেষ হয়ে গেছে। অনেক ভোটার একটু দেরী করে কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পেরেছেন, তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে! সিলেটে নির্বাচনী খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশ আর ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন সাংবাদিকও।
তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহন হয়েছে রাজশাহীতে। সেখানে বড় কোন ঝামেলার খবর পাওয়া যায়নি। বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ভোট দেননি, এটাই দিনের সবচেয়ে আলোচিত খবর এখানে। শহরের স্যাটেলাইট উচ্চবিদ্যালয়ে তার ভোট দেয়ার কথা থাকলেও, বিভিন্ন কেন্দ্রে এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না শুনে সেসব জায়গায় ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। এরমধ্যে সকাল এগারোটায় ইসলামীয়া কলেজ কেন্দ্রে ব্যালট শেষ হয়ে গেছে শুনে সেখানে গিয়েছিলেন বুলবুল। কিন্ত কোন সদুত্তর পাননি সেখানে গিয়ে। বাকীটা দিন ওই কেন্দ্রে মাঠেই বসে ছিলেন বুলবুল। তিনি অভিযোগ করেছেন, রাতেই ব্যালটে সিল মেরে রাখা হয়েছিল, সকালে সেগুলো তাড়াহুড়ো করে বক্সে ঢোকানো হয়েছে শুধু।
ভোট গণনা করা হচ্ছে, সরকারদলীয় প্রার্থীদের অনুকূলেই যাচ্ছে ফল, যেমনটা অনুমান করা হয়েছিল। বিএনপি এখন কূলহারা একটা দল, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংরাম করছে তারা। তবুও তাদের ঠেকাতে এমন পেশীশক্তির প্রদর্শনটা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। নির্বাচনে বেশিরভাগ প্রার্থীই ছিটিয়েছেন অজস্র টাকা। এত টাকা, এত শ্রম, এত আয়োজন করে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দরকারটা কি, সেটাই মাথায় ঢোকে না। বরং সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসক ঠিক করে দিলেই হয়। ঝামেলা কমলো, অবাধে টাকাপয়সার ওড়াউড়ি বন্ধ হলো, সরকারের টাকাও বাঁচলো, সময়টাও নষ্ট হলো না। অথবা নির্বাচনের দিন কারফিউ ঘোষণা করে দেয়া হোক, লোকজন ঘরে বসে থাকুক। ভোট তো অটোমেটিক পড়ে যাবে, সেটা সবাই জানে। মানুষের আর বাড়তি পরিশ্রম করা লাগলো না। নির্বাচন মানে যখন শুধু লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যায়, তখন সেই আনুষ্ঠানিকতা পালনের চাইতে বন্ধ করে দেয়াই বোধহয় ভালো। (তথ্য সূত্রঃ এগিয়ে চলা.কম)
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৩১ জুলাই