শাজাহান খান যাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন

ঘটনাটি ২০০৭ সালের। উত্তর-পশ্চিম লিথুনিয়ার স্কুয়োডাস জেলার আলেকজান্দ্রিয়া গ্রামে ওই জেলার ২৭ বছর বয়সী তরুণ পুলিশ অফিসার সাওলিয়াস পাওলিকাস তার বিএমডব্লিউ গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনাক্রমে তিনটি দশ বছর বয়সী বালকের গায়ের উপর গাড়ি তুলে দেন, এবং ওই তিন বালকেরই মৃত্যু ঘটে। পাওলিকাস যদি সাথে সাথেই বালকদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন বা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতেন, তাহলে হয়ত তাদেরকে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু তা না করে তিনি ভয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় আলোড়ন পড়ে যায় পুরো দেশব্যাপী। দেশের জনগণ শুধু ওই পুলিশ অফিসারেরই নয়, পাশাপাশি এই ঘটনায় পরোক্ষভাবে হলেও যুক্ত থাকতে পারে এমন সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিচারের দাবি জানাতে থাকে। বিক্ষোভ যখন সাধারণ অবস্থার সীমা অতিক্রম করে যায়, তখন লিথুনিয়া পুলিশ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে নেমে পড়ে। প্রথমে পাওলিকাস পুলিশের কাছে ধরা দেন, এবং গাড়ি চালানোর সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন কি না তা খতিয়ে দেখা হয়। অবশ্য তার রক্তে এক ফোঁটাও অ্যালকোহলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে তার রক্ত পরীক্ষা করা হয় ঘটনার ১৭ ঘণ্টা পরে। সেজন্য তিনি যদি গাড়ি চালানোর সময় আসলেও মদ্যপ অবস্থায় থাকেন, তা ধরা নাও পড়তে পারে। তারপরও সেটিকে সম্ভাবনা কারণ হিসেবে ধরে নিতে চায় লিথুনিয়া পুলিশ। কারণ তা না হলে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা তিনটি বালকের গায়ের উপর সোজাসুজি গাড়ি তুলে দেয়ার আর কীই-বা যুক্তি থাকতে পারে!
এমতাবস্থায় পুলিশ যখন সরাসরি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারছিল না, তখন নিজেদের ব্যর্থতার দায় কাঁধে তুলে নিয়ে একে একে পদত্যাগ করেন লিথুনিয়ার ইন্টেরিয়র মিনিস্টার রাইমোন্ডাস সুকিস এবং পুলিশ কমিশনার জেনারেল ভায়াটাউটাস গ্রিগারাভিসিয়াস। এ ঘটনার পর ব্যাপক পরিবর্তন আসে লিথুনিয়ার প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পুলিশি কার্যক্রমে। দেশটির রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ই স্বীকার করে নেন যে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বাহিনী উভয় জায়গাতেই যোগ্য মানুষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যার ফলস্বরূপ প্রাণ হারাতে হয়েছে নিষ্পাপ তিনটি বালককে। তাই সরাসরি ইন্টেরিয়র মিনিস্টার ও পুলিশ কমিশনার যদিও দুর্ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু একটি ঘুণেধরা, মরচে পড়া সিস্টেম গড়ে উঠেছিল তাদেরই মদতে।
সেজন্যই ঐ দুই ব্যক্তির অব্যাহতিকে স্বাগত জানান তারা, এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেন গোটা সিস্টেমকেই ঢেলে সাজানোর। অনেকের কাছেই তিনজন বালকের মৃত্যুর ঘটনাটিকে অতি সামান্য একটি ঘটনা বলে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব ঘটনা পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট করে দুই ইঞ্চি ও এক কলামে ছাপা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে যে ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে ‘অতি সামান্য’, সেটিই লিথুনিয়ার মানুষের কাছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই খোলনলচে পাল্টে যায় দেশটির প্রশাসনিক ব্যবস্থার, এবং একই সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমের। এবং এই পুরোটাই সম্ভব হয়েছে একদম উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তার পদত্যাগের মাধ্যমে, যাতে করে বাকিরাও বুঝতে পেরেছে যে নিজেদের কর্তব্যে গাফিলতি করলে কোন ছাড় নেই।
এবার যে ঘটনাটি আপনাদের বলব, সেটি বছর চারেক আগের। এবং এটির গুরুত্ব নিশ্চিতভাবেই আগের ঘটনাটির চেয়েও বহুলাংশে বেশি। কারণ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন স্বয়ং একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ায়। ৩,৬০৮ টন কার্গো বোঝাই একটি ফেরি ডুবে গিয়ে মৃত্যু ঘটে তিন শতাধিক মানুষের, প্রাণে বাঁচে মাত্র ১৭৪ জন। কাগজে কলমে ওই ফেরিতে উঠবার অনুমতি ছিল মাত্র ১৫০টি গাড়ি ও ৬৫৭ টন কার্গোর। কিন্তু বাস্তবে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি পরিমাণ ভার ফেরিটিকে বহন করতে হয়েছিল, যার ফলে ফেরিটি ডুবে যায় বলে তদন্তকারীদের প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। একে তো নিয়মকানুন না মেনে অনেক বেশি পরিমাণ কার্গো উত্তোলনের মাধ্যমে ফেরিটিকে দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, তার উপর ফেরিটি যখন ডুবে যায়, তখনও সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময় মত উদ্ধারকাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে অনেক মৃতদেহের এমনকি হদিস পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সবমিলিয়ে এই ফেরি ডুবে যাওয়া থেকে শুরু করে এর উদ্ধারকাজ, এবং পরবর্তীতে তদন্তকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের গাফিলতি – দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত অধ্যায় এটি। এবং স্বাভাবিকভাবেই এত বড় একটি কলঙ্কের দায়ভার অবশ্যই দেশটির অভিভাবক যেই ব্যক্তি, তার কাঁধেই বর্তায়। ফলে ব্যর্থতার দায় মেনে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী চুং হং ওন।
তাহলে পাঠক, উল্লিখিত এই দুইটি ঘটনার সাথে কি বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতির কোন প্রাসঙ্গিক যোগসাজশ খুঁজে পাচ্ছেন? লিথুনিয়ার একটি সড়ক দুর্ঘটনা সে-দেশের গোটা সিস্টেমকেই পাল্টে দিয়েছে, আর দক্ষিণ কোরিয়ার নৌ দুর্ঘটনায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেখানে আমাদের দেশে তো প্রতি বছরই অগণিত সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা ঘটে চলে, এবং চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা কখনও পদত্যাগ করা তো দূরে থাকুক, এসবের পিছনে অন্তত নিজেদের দুর্নীতি ও কর্তব্যে অবহেলার বিষয়গুলিকে স্বীকার করে নেবেন, নাকি একেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যমের সামনে কেবল নির্লজ্জ হাসিই হেসে যাবেন?(তথ্য সূত্রঃ এগিয়ে চলা.কম)
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৩১ জুলাই