গ্রামে তাল অর্থনীতি, বজ্র ঠেকায় তাল গাছ

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১১:০৮ এএম, ১৯ জুন ২০১৮ | আপডেট: ১১:৪৪ এএম, ১৯ জুন ২০১৮

গ্রামে তাল অর্থনীতিমির্জা খালেদ
‘তালগাছ একপায়ে দাড়িয়ে ,উকিঁ মারে আকাশে’ শৈশবকে নাড়া দেয়া এমন কবিতা যেমন লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাল রয়েছে খনার বচনে ও একাধিক বার উদ্ধৃতি। তাল নিয়ে আছে ডজন ডজন কবিতা,ছড়া বা ভুতুরে গল্প । কিন্তু তাল এখন ছড়া ও কবিতা থেকে বেড়িয়ে গ্রামীন অর্থ নীতিতে স্থান করে নিচ্ছে। শুধু অর্থনীতি নয় তাল গাছ বজ্রপাতের মত দূর্যোগ প্রতিরোধে অন্যতম নিয়ামক। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিটি উপজেলায় রোপন করা হবে ভূমি ক্ষয়রোধক তাল গাছ। তাল গাছ থেকে আহরিত দ্রব্য কয়েক স্তরে মূল্য সংযোজ হচ্ছে। তাল দেশের গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত ফল।

পাথরঘাটা উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের গোলবুনিয়া গ্রামের অশেষ বরণ তালুকদার একজন সাধারন কৃষক। বাড়ির ঝোপ ঝাড়ে বেড়ে ওঠা ৫টি তাল গাছের কাচাঁ তাল (শাসঁ সহ) বিক্রী করেছেন ৩ হাজার টাকা। তিনি অবশ্য তিনটি শাঁস সহ প্রতিটি তাল বিক্রী করেছেন এক টাকা দরে। একই ভাবে তার প্রতিবেশী দেবব্রত গোমস্তা ও গৌতম গোমস্তা তাঁদের বাড়ির ঝোপঝাড়ে বা রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা তাল গাছের সকল কাচাঁ তাল বিক্রী করে দিয়েছেন বিভিন্ন দরে। চরদুয়ানী ইউনিয়নের দক্ষিন চরদুয়ানীর আবদুল করিম বলেন, তিনি প্রতি বছর তালের রস থেকে গুড় তৈরী করে বাজারে বিক্রী করে ২০-২৫ হাজার টাকা টাকা আয় করে থাকেন। সবাই এভাবে অর্জিত টাকা দিয়ে পরিবারের ছোট খাট ব্যায় নির্বাহ করেন। প্রতি বছর এভাবেই প্রত্যেকে তাল বিক্রীর টাকা আয় ধরে পরিবারের ব্যায় নির্বাহের হিসাব কষে থাকেন।

গ্রাম থেকে শহরে কাচাঁ তাল চালান দেয় উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের মো. জাফর হাওলাদার বলেন,প্রতিদিন লঞ্চে বোঝাই করে ঢাকার শ্যাম বাজারে পাঠাই। বরগুনা থেকে ঢাকাগামী একটি দোতালা লঞ্চের সুপারভাইজার মো. আলম বলেন, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে বরগুনা থেকে বেতাগী পর্যন্ত প্রতি ঘাট থেকে শতশত কাঁচা তালের ছড়া ঢাকায় যায়। ঢাকার শ্যামবাজারের আরৎদার মো. আজাদ মিয়া বলেন, লঞ্চে প্রতিদিন উপকূল এলাকা থেকে এক হাজার থেকে ১২ শ ছড়া (প্রতিটিতে ২০/২৫টি তাল হয়) বিক্রীর জন্য আসে। তাল গাছে তালমৌসুমে এভাবে কাওরান বাজার, সোয়ারী ঘাট, যাত্রাবাড়ি সহ বিভিন্ন স্থানে ২০ থেকে ২৫ হাজার ছড়া তাল বিক্রীর জন্য পৌঁছে।ঢাকায় দৈনিক তালের শাঁস বিক্রী থেকে ৫০ লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানান শ্যামবাজারের আরৎদার মো. আজাদ মিয়া।

অর্থনীতিতে তাল গাছের রয়েছে বহুমূখী অবদান। প্রতিটি তালে ২ থেকে ৩টি শাঁস হয়। গ্রীস্মের সময় কঁচি অবস্থায় তালের শাঁস ব্যপক চাহিদা থাকে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত। হাত বদল হয়ে বরিশাল বা ঢাকায় পৌছে প্রতিটি তালের (তিন শাসঁ) মূল্য দাড়ায় ১৫ টাকা। তালের রস, রস থেকে গুড় তৈরী, তাল মিশ্্ির, পাকা তালের পিঠা, পাকা তালের শাঁস দিয়ে তৈরী হয় সুস্বাধু মোরব্বা,তালের পাখা, একসময় পাঠ শালায় লেখার জন্য ব্যহৃত হত তাল পাতা। তালের কাঠ গ্রামীন আবাসন তৈরীতে মূল্যবান কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২৫/৩৫ বছর বয়সের একটি তাল গাছের মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন পাথরঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রাপ্ত কৃষিবিদ মো. আবদুল হাকিম। মৌসুমে ( মার্চ থেকে জুন)একটি তাল গাছ থেকে ৭শ থেকে ১৫শ লিটার রস সংগ্রহ সম্ভব। পুরুষ/স্ত্রী উভয় প্রকার গাছ থেকেই রস সংগ্রহ করা সম্ভব।

তালের রয়েছে ঔষধিগুন সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদন । অন্য ফলের তুলনায় এ ফলে ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালোরির উপস্থিতি অনেক বেশি।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরর কৃষি ও গ্রামীন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. বদিউজ্জামান প্রতিনিধিকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত ফল হচ্ছে তাল,গ্রামীন অর্থনীতিতে তাল গাছের অবদান ফেলনা কিছু নয় বরং টেকসই ,লবন সহিসনু, ভুমিক্ষয় ও ঝড় বাদল প্রতিরোধক একটি গুচ্ছমূল প্রজাতির একটি গাছ। কৃষকের বাৎসরিক পারিবারিক বাজেটে ভুমিকা আছে এ গাছের। ধান বা পাট খেতে অথবা উপকূলের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধেঁ তাল গাছের বাগান করা যায়। সৌদি আরবে একই প্রজাতির খেজুর গাছের বাগান করা হয়। তাদের অর্থনীতিতে এর অবদান অনেক।
তালগাছ একপায়ে দাড়িয়ে
শুধু অর্থনীতি নয় তাল গাছ বজ্রপাতের মত দূর্যোগ প্রতিরোধে অন্যতম নিয়ামক বলে জানালেন বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন,সরকারের উদ্যোগে সারা দেশে তাল বীজ লাগান হচ্ছে। এবছর বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলার বিভিন্ন সড়ক,পুকুর পাড় ও খালের পাড়ে ৬লাখ তাল গাছের বীজ বপন করা হবে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো:সামসুজ্জোহা প্রতিনিধিকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সাম্প্রতিক দূর্যোগ, বজ্রপাত থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য উচু তাল গাছ ব্যবহার আমাদের লোকায়ত জ্ঞানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়া এবং গ্রামে তালগাছ কমে যাওয়ার কারনেই দেশে বজ্রপাত আতংক তৈরী হয়েছে। তাল গাছ উচু হওয়ায় বজ্রপাত নিজে গ্রহন করে মানুষ সহ প্রানীদের রক্ষা করে থাকে।

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/১৯ জুন

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)