লজ্জায় আত্মগোপন করছেন অবিবাহিত ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীরা
উখিয়া বালুখালী ২ নম্বর ক্যাম্পের ১৪ নম্বর ব্লকে আশ্রয় নেওয়া এক ব্যক্তির ৬ ছেলে-মেয়ে। মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় তার প্রথম মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কিন্তু সেনা অভিযান শুরু হওয়ায় সে বিয়ে আর হয়নি। ওই মেয়ের বয়স সবে ১৭ অতিক্রম করেছে। এখন পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে
নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকলেও ওই ব্যক্তির দুশ্চিন্তা তার বড় মেয়েকে নিয়ে। তার মুখে কথা নেই, চোখে ঘুম নেই অবস্থা। কারণ মিয়ানমারের মংডু থানার সিকদারপাড়ায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ধর্ষণের শিকার হয় এই মেয়ে। বিষয়টি তেমন কেউ না জানলেও, এপারে চলে আসার পর আর লুকোচাপা রাখা যাচ্ছে না। মেয়েটি এখন গর্ভবতী। তার শারীরিক পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। তাই তিন সপ্তাহ আগে মেয়েকে ব্লকের অন্য প্রতিবেশীর চোখের আড়াল করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পের বাইরে একটি নারী ও শিশু আশ্রয় কেন্দ্রে। যে কেন্দ্রে অতি গোপনে এ রকম কুমারী মাতাদের এবং ধর্ষিত নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, তারা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করে যাচ্ছে কাজটি। তাই ওই মেয়ের বাবাকে অতি গোপনে ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। প্রতিবেশীদের বলা হয়েছে—তাদের মেয়ে কয়েকদিনের জন্য উখিয়ার অন্য একটি ক্যাম্পে থাকা তার খালার বসতিতে বেড়াতে গেছে। মিথ্যে বলে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে মেয়েকে আপাতদৃষ্টিতে আড়াল করতে পারলেও দুশ্চিন্তা থেকে ওই পরিবারটি এক মুহূর্তের জন্যও মুক্তি পাচ্ছে না। কঠিন পরিস্থিতির মুখে কেবল ওই পরিবারটিই নয়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অনেক পিতা-মাতা ও ধর্ষিতা নারীর স্বামী-স্বজনরাই এমন দুঃসহ পরিস্থিতির শিকার। অনেকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পেরে নানা নেতিবাচক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ৯ মাস পার হয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে জতিগত নিধন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে পরবর্তী তিন মাসে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু সে াতের মতো এদেশে অনুপ্রবেশ করে। এ সময় রোহিঙ্গা নারীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও স্থানীয় মগ-মুরংদের হাতে চরমভাবে যৌন সহিংসতার শিকার হন। সে সময় উখিয়া ও টেকনাফের ২০টি ক্যাম্পে ৬০ হাজারেরও বেশি নারী গর্ভবতী ছিলেন বলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে উঠে আসে। পরবর্তীতে ক্যাম্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে যেমন ৩০টি হয় এবং গর্ভবতী নারীর সংখ্যাও তেমন লাখ ছাড়িয়ে যায়। এখানে এখন প্রতিদিন ৬০টি শিশু জন্ম নিচ্ছে বলে সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার হিসেবে প্রতিদিন নবজাতক জন্ম নেওয়ার গড় সংখ্যা আরও বেশি।
লক্ষাধিক গর্ভবতী নারীর মধ্যে ২০ শতাংশ নারীই মিয়ানমারে যৌন সহিংসতার শিকার হন। যাদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অবিবাহিত। এই অবিবাহিত গর্ভবতী নারীদের নিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আগামী মাসের শুরু থেকে জন্ম নেবে হাজারো অপ্রত্যাশিত শিশু। যে শিশুগুলোর অধিকাংশই পরিত্যক্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকে এরই মধ্যে অপরিণত শিশুর জন্ম দিতে চলেছেন। ধর্ষণ এবং গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে জানাজানি হয়ে গেলে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হতে হচ্ছে ওই নারী ও তার পরিবারকে। এ অবস্থা থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দান সংস্থা।
যে সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে একটু দূরে অবস্থান নিয়ে গর্ভবতী নারীদের ৪/৫ মাস ধরে আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এসব সেবা কেন্দ্রের বাইরে কোনো সাইন বোর্ড বা কোনো চিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছে না। উখিয়া ও টেকনাফে এ ধরনের ৬টি আশ্রয় ও সেবাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে বলে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবী ও বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের সূত্রে জানা গেছে। এই সেবা কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবী ও মাঠকর্মীরা ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে যৌন সহিংসতার শিকার নারী (বিবাহিত-অবিবাহিত) ও তাদের পিতা-মাতা এবং স্বামীকে বুঝিয়ে কৌশলে সেবা কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন।
সরেজমিন গিয়ে আরও জানা গেছে, এরই মধ্যে অনেক কুমারী মা তাদের অপ্রত্যাশিত শিশুর জন্ম দিতে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে ওই মা কিংবা তার পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুটিকে পরিত্যক্ত করলে তাকে যথাযথভাবে লালন-পালনেরও উদ্যোগ নিচ্ছে এসব নারী ও শিশু আশ্রয় কেন্দ্র। একই সঙ্গে ধর্ষিতা কিংবা কুমারীমাতার মা হওয়ার বিষয়টি গোপন রেখে পুরোপুরি সুস্থ-স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।