বিলীনের পথে বেতাগীর এতিহ্যবাহী শাহী মসজিদের নিদর্শন !
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে গড়ে ওঠা বরগুনা জেলায় অবস্থিত বেতাগী উপজেলা। একদিকে পায়রা ও বলেশ্বর নদী পুরো স্থান জুড়ে আছে বিষখালীর বিশাল জলরাশি। অসংখ্য খাল-বিল, নদ-নদী আর সবুজ বন বনানীর সৌন্দার্যের পসরা নিয়ে সাজানো ঐতিহ্যবাহী এ জনপথ। এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সর্ম্পকে দেশর কম মানুষের জানা ।
তবে জানার শেষ নেই দেখার ও শেষ নেই অনেকসময় এক একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র । বরগুনার বেতাগী উপজেলা সদর থেকে আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার পথ অগ্রসর হলেই বিবিচিনি গ্রাম। আলো জ্বলছে সদা। দিগন্তজাড়া সবুজের বর্নিল আতিথেয়তায় উদ্ভাসিত ভিন্ন এক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে উঁচু টিলার উপর মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে মোঘল স্থাপত্যকর্ম এই ঐতিহাসিক মসজিদ। এ এক হৃদয় ছোঁয়া পরিবেশ যা মনের আবহাওয়াকে মুগ্ধ করে। দেশের অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে বিবিচিনি মসজিদ একটি। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই মসজিদকে গোটা দক্ষিন বাংলার যতগুলো ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রীয় মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই উজ্জ্বল নির্দশনটি টিকে থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ এর ঐতিহ্য অনেকটা হারিয়ে গেছে। তবু এর অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ পুরানো ঐতিহ্য স্মরন করিয়ে দেয়। তৎকালীন সময়ে মসজিদটির অনেক জৌলুস ছিলো বলে স্থানীয় বৃদ্ধ লোকদের মুখে শোনা যায় ।
মসজিদ ঘিরে রয়েছে আরও অনেক অলৌকিক ঘটনার কাহিনী ও নানা ইতিহাস। জানা যায়, এই মসজিদের নির্মাতা সাধক নেয়ামত শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সাথে বিবিচিনি গ্রামের ও নামকরন করা হয়েছে। আবার অনেকে বলেন চিনিবিবি থেকেই বিবিচিনি নামের সৃষ্টি হয়েছে। মসজিদটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক বিষ্ময়কর স্থান হিসাবে গুরুত্ব বহন করে আসছে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বাংলার অন্যতম মোঘল স্থাপত্যশিল্প এবং এলাকার পুরনো দিনের অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবেও দক্ষিনাঞ্চল তথা সমগ্র দেশের নীরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মসজিদ। এক সময় এ অঞ্চল ছিল মগ অমুসলীম ফিরিঙ্গিদের তুমুল হামলার আড্ডা ভূমি। হামলার প্রতিরোধ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মসজিদটি অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। মগ ফিরিঙ্গীদের দমনের জন্য শাহ্সুজা ঝালকাঠির সুজাবাদেও এক সেনানিবাস গড়ে তোলেন, উহা সুজাবাদ কেল্লা নামে পরিচিত।
তৎকালীন সম্রাট শাহজাহানের সময় সূদুর পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে শাহ নেয়ামতউল্লাহ দিল্লীতে আসেন। এ সময় দিল্লীর সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গ দেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন এবং কতিপয় শিষ্যসহ বজরায় চড়ে তিনি ইসলাম প্রচার ও ইবাদতের জন্য ভাটির মূলকে প্রবেশ করেন। শাহ নেয়ামতউল্লাহ বজরায় চড়ে দিল্লী থেকে রওনা হয়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে এসে পৌঁছলে বিবিচিনিতে শাহজাদা বাংলার সুবেদার মোহাম্মদ শাহসুজার অনুরোধে একই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নেয়ামতি। নেয়ামতিও নেয়ামত শাহের নামানুসারে নামকরন করা হয় বলে জানা যায়।
সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া বিশিষ্ট। দক্ষিনে এবং উত্তর দিকে তিন তিনটি দরজা রয়েছে। এগুলো খিলানের সাহায্যে নির্মিত হয়। মসজিদের ইটগুলো বর্তমানের আধুনিক যুগের ইটের মত নয়। ইহা মোঘল আমলের তৈরী ইটের মাপের ন্যায়। ইহার দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চিএবং চওড়া ২ ইঞ্চি। সমতল ভূমি হতে মসজিদ নির্মিত স্থানটি আনুমানিক কমপক্ষে ৩০ ফুট সুউচ্চ টিলার উপর অবস্থিত। তার উপরেও প্রায় ২৫ ফুট মসজিদ গৃহ।
ঐতিহাসিক বিবিচিনি মসজিদের সাথে যে নামটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত আছে তিনি হলেন মহান আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পীঠ স্থান তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে এই খ্যাতনামা সাধক পুরুষ ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পর্দাপন করেন। পরবর্তী এ অঞ্চলে আগমনের পর একই খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় শাহ্ নেয়ামতুল্লাহ এই স্থাপত্যর্কর্ম বিবিচিনি মসজিদ নির্মান করেন। সমুদ্র সৈকতের দক্ষিন বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রদীপ্ত ভাস্কর ছিলেন শাহ নেয়ামতুল্লাহ। তিনি ছিলেন এক অসাধারন ব্যক্তিত্ব। যার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। একজন মানুষ যার জন্মই ছিলো অসাধারন সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে। যার ব্যক্তি মর্যাদা ও অলৌকিকতার গুনে বহু হিন্দু, বৌদ্ধ দীক্ষিত হয় ইসলাম ধর্মে।এ ছাড়াও জনবহুল বৃহত্তর বরিশালের হাজার হাজার মুসলিম জনগোষ্ঠী শাহ নেয়ামতুল্লাহ শিষ্যত্ব গ্রহন করে।
এই প্রিয় ব্যক্তিত্বের অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। জানা যায়, তখনকার সময় বিষখালী নদীর পানি ছিলো লবনাক্ত।পানি পানের উপযোগী ছিলো না। সুপেয় পানির অভাবে জনগন বহুকষ্ট পেত। নেয়ামত শাহ মানুষের এই কষ্টের কথা অনুভব করে তার সাধকতার আশ্চর্য তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দিলে পানি হয়ে যায় সুপেয়। আজও সেই পানি একই অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন বিষখালী নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। তার অলৌকিক প্রচেস্টায় বিবিচিনি সংলগ্ন বিষখালী নদী এলাকায় কোন কুমীর আসতনা। এ কাহিনী এখনোএ এলাকায় প্রচলিত রয়েছে।
এই দর্শনীয় শোভা বধর্নকারী মসজিদটি ঘিরে রয়েছে নানাধরনের ঘটনা যা মানুষের মনে কৌতুহল সৃষ্টি করে। শোনা যায়, পূর্বেকার সময় স্বপ্নে প্রাপ্ত দূরবর্তী অনেক লোকজন এই মসজিদ থেকে গুপ্তধন নিয়ে যেত। প্রতিদিন এখানে অগনিত নারী পুরুষ এসে নামাজ আদায় করে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট তাদের নেক মকসুদ পূর্নতা লাভের উদ্দেশ্যে। এছাড়া টাকা পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যেত মসজিদ প্রান্তে। প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য মানুষ এসে সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগী করে কাটায়। যে যে ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে এখানে আসে তার অধিকাংশ আশাই পূর্ন হয় বলে অসংখ্য মানুষের কাছে শোনা যায়।মোঘল আমলের এ দীঘি থেকে মানুষ যা চাইতো তা ইচ্ছানুযায়ী পাওয়া যেতো বলে শোনা যায়।আর তাই মসজিদের নিকটবর্তী বড় দিঘীটি ইছাবিবির দীঘি নামে পরিচিত।
তবে বর্তমানে এসব দীঘির অস্থিত্ব বিপন্ন প্রায়। প্রসাদের মতো অপরূপ কারুকাজ মন্ডিত মসজিদটির রয়েছে নানা ইতিহাস। জানা গেছে, মোঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদার ও ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে দেশেই নয় বাংলাদেশের বাহিরেও এমনকি ইতিহাস খ্যাত বৃটেন যাদুঘরেও এ স্থাপত্যটি সম্পর্কে নির্দশন পাওয়া গেছে। যা পাঁচশত বছরের পূর্বের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি ব্যতিক্রম ধর্মী কবর, কবরগুলো সাধারন কবরের ন্যায় হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং সহোদর চিনিবিবি ও ইছাবিবি। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে নেয়ামত শাহের ইহকাল ত্যাগের পর তাকে এ স্থানে সমাহিত করা হয়।সাধক নেয়ামত শাহের নির্মিত বিবিচিনির ইতিহাস সমৃদ্ধ মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দীর্ঘ দিন সংস্কার বিহীন থাকার পর প্রায় ১২ বছর পূর্বে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
অনেকপূর্বে এ কাজ সম্পন্ন হলেও তা যথেষ্ট নয়। জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে মসজিদের আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সংস্কারের জন্য প্রতœতত্ত্ব বিভাগ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। মসজিদটির এখনো অনেক কাজ বাকি। নির্দশনটি দেখতে আসা-যাওয়ার উপযোগী রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি পান, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের ব্যবস্থা নেই। মসজিদটি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য একজন কেয়ারটেকার থাকলেও নেই অন্য কোন দায়িত্বশীল লোক।
মসজিদটি প্রয়োজনীয় রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে দিন দিন ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কতিপয় লোক মসজিদের টিলার পাদদেশ কেটে জমি বৃদ্ধি করে চাষাবাদ করছে বলে স্থানীয়রা বলেন।এ ব্যপারে বর্তমান মসজিদ কমিটির সভাপতি বেতাগী উপজেরা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব, মোঃ রাজীব আহ্সান এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি এই মসজিদের উন্নয়নের জন্য অত্র ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নয়ন মিয়াকে পরিষদের অর্থায়ন দিয়ে উন্নয়নের স্বার্থে সহায়তা করার জন্য বলেছি তাছাড়া আগামী অর্থবছরে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে এর জন্য একেটি বরাদ্দ দেয়া হবে ।