প্রিয় রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য

সর্বোত্তম কথা ও সর্বোত্তম আদর্শ: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কিতাবই শ্রেষ্ঠ বাণী এবং মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শই শ্রেষ্ঠ আদর্শ (যার অনুসরণ করতে হবে)। [মুসলিম]
কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা রাসূলের সুন্নাত
হযরত আনাস (রা.) বলেন রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেনঃ প্রিয় বৎস, তুমি যদি এভাবে জীবন যাপন করতে পার যে, তোমার মনে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অশুভ কামনা নেই, তাহলে তাই কর। এটাই আমার সুন্নাত বা নীতি। অর্থাৎ আমি কারো প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা বা অশুভ কামনা পোষণ করিনা। যে ব্যক্তি আমার নীতিকে ভালোবাসে, নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। [মুসলিম]
দুনিয়া ত্যাগ তথা বৈরাগ্যবাদ রাসূলের নীতি নয়
একবার তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এবাদত বন্দেগী সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের লক্ষে তাঁর স্ত্রীদের কাছে এল। যখন তাদেরকে জানানো হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) কেমন এবাদত বন্দেগী করেন, তখন তাঁরা তাঁর সামনে নিজেদের এবাদত বন্দেগীকে অত্যন্ত কম ও নগণ্য মনে করলো। তারা মনে মনে বললো, রাসূল (সা.) এর সামনে আমরা কোথায়? তাঁরতো আগেও কোন গুনাহ ছিল না, পরেও কোন গুনাহ হবে না। (আর আমরা তো নিষ্পাপ নই। কাজেই আমাদের বেশী করে এবাদত বন্দেগী করা উচিত।) এরপর তাদের একজন বললো, আমি সব সময় নফল এবাদত করে পুরো রাত কাটিয়ে দেব। আর একজন বললো আমি সব সময় নফল রোযা রাখবো, দিনের বেলা কখনো পানাহার করবো না। আর একজন বললো, আমি সব সময় নারীদেরকে এড়িয়ে চলবো, কখনো বিয়ে করবো না। রাসূল (সা.) (যখন এ সব জানতে পারলেন তখন) তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন, তোমরাই কি এসব কথা বলছিলে? তারপর তিনি বললেন শোন, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তাঁর অবাধ্যতা বেশী এড়িয়ে চলি। অথচ আমি কখনো (নফল) রোযা রাখি, আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে আমি কখনো নফল পড়ি, আবার কখনো ঘুমাই। আর আমি বিয়েও করেছি। (কাজেই আমার রীতিনীতি অনুসরণ করাতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত।) যে ব্যক্তি আমার রীতিনীতির গুরুত্ব দেয় না ও উপেক্ষা করে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। [মুসলিম]
আল্লাহ ভীতির প্রকৃত পরিচয়
একবার রাসূল (সা.) একটি কাজ নিষিদ্ধ করে দিলেন। পরে আবার তার অনুমতি দিলেন, কিন্তু এরপরও কিছু লোক সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে থাকতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এই মানসিকতার কথা জানতে পেরে একটা ভাষণ দিলেন। (সেই ভাষণে) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন কিছু লোক আমি যে কাজ করি, তা থেকে বিরত থাকছে কেন? আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখি এবং আল্লাহ তায়ালাকে তাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। [বোখারী ও মুসলিম]
ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুসরণের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি
হযরত জাবের (রা.) বলেন, একবার হযরত ওমর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এলেন এবং বললেন, আমরা ইহুদীদের কাছে থেকে এমন এমন বাণী শুনি, যা আমারে কাছে ভালো লাগে। আপনি কেমন মনে করেন, যদি আমরা তাদের সেই সব বাণী থেকে কিছু কিছু লিখে রাখি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইহুদী ও খৃষ্টানরা যে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, তোমারাও সেই গোমারাহীতে লিপ্ত হতে চাও নাকি? আমি তোমাদের কাছে থেকে এমন উজ্জ্বল নিখুঁত ও সহজ বিধান নিয়ে এসেছি যে, এমনকি আজ যদি স্বয়ং মূসাও (আ.) বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিও আমার এই বিধান অনুসরণ না করে পারতেন না। [মুসলিম]
ইহুদী খৃষ্টানরা তাদের কাছে অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করে ফেলেছিল। তবে পুরোপুরি বিকৃত করতে পারেনি। তাতে কিছু কিছু ভালো কথাও অবশিষ্ট ছিল। মুসলমানরা সে সব কথা শুনতো এবং তা তাদের কাছে ভালো লাগতো। রাসূল (সা.) যদি সেই সব বাণী লিখে রাখার অনুমতি দিতেন, তা হলে ইসলামের নিদারুণ ক্ষতি হয়ে যেত। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, তার কিছু না কিছু ভালো কথা আছে। তাই বলে যার নিজ বাড়িতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানির ঝর্ণা বিদ্যমান, অন্যের ঘোলা পানির চৌবাচ্চার কাছে ঝর্ণা দেয়া তার শোভা পায় না। হযরত ওমরকে রাসূল (সা.) যে জবাব দিলেন, তা থেকে এই কথাটিই সুস্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে।
প্রকৃত ঈমানের দাবী
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যতক্ষণ (কাঙ্ক্ষিত মানে উত্তীর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ তার ইচ্ছা ও মনে ঝোঁক আমার আনীত বিধানের (তথা কোরআনের) অনুসারী না হয়। [মেশকাত]
অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর ওপর ঈমান আনার দাবী হলো, নিজের কামনা বাসনা, ইচ্ছা ও মনের ঝোঁক প্রবণতাকে রাসূলের আনীত বিধানের অনুগত করে দিতে হবে এবং নিজের খেয়াল খুশী ও খায়েশের বাগডোর ও নিয়ন্ত্রণভার কোরআনের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এটা না করতে পারলে রাসূল (সা.) এর ওপর ঈমান আনার দাবী নিরর্থক হয়ে পড়বে।
ঈমানের মাপকাঠি
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের বাবা, সন্তান ও অন্য সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব, ততক্ষণ তোমরা মুমিন হতে পারবে না। (বোখারীও মুসলিম, হযরত আনাস থেকে বর্ণিত) রাসূল (সা.) এর এ উক্তির মর্মার্থ এই যে, মানুষ প্রকৃত মুমিন তখনই হয়, যখন তার মনে রাসূল ও তার আনীত দ্বীন ঈমানের ভালোবাসা অন্য সমস্ত ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার চেয়ে প্রবল হয়। সন্তানের স্নেহ মমতা মানুষকে একদিকে যেতে বলে, বাবার প্রতি ভালোবাসা অন্য একদিকে চলতে প্ররোচনা দেয়, আর রাসূল (সা.) দাবী জানান অন্য এক পথে চলার। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি অন্য সমস্ত স্নেহ, মমতা ভালোবাসার দাবী প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র রাসূল (সা.) এর আদিষ্ট পথে চলতে প্রস্তুত ও বদ্ধপরিকর হয়, বুঝতে হবে সেই ব্যক্তিই পাক্কা মুমিন, সেই রাসূল (সা.) কে যথাযথভাবে ভালোবাসে। এই মানের ঈমানদারই ইসলামের প্রয়োজন। এ ধরনের দুরন্ত মুমিনেরাই পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস গড়ে। কাঁচা ও দুর্বল ঈমান নিয়ে কেউ পিতা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ইসলামের পথে চলতে পারে না।
আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ
হযরত আবদুর রহমান বিন আবি কিরাদ বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ওযু করলেন। তখন তাঁর কিছু সাহাবী তার ওযুর পানি হাতে নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে মাখাতে লাগলেন। তা দেখে রাসূল (সা.) বললেন কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তোমরা এ কাজ করলে? তারা বললেন আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলকে ভালোবাসে অথবা আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসা পেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করতে চায়, তার উচিত যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হবে, তখন আমানত হিসাবে রক্ষিত জিনিস অক্ষতভাবে মালিককে ফিরিয়ে দেবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। [মেশকাত]
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওযু করা পানি হাতে নিয়ে বরকতের উদ্দেশ্যে মুখে মাখানোর কারণ ছিল রাসূলের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। এটা কোন মন্দ কাজ ছিল না যে, তার জন্য রাসূল (সা.) তাদেরকে তিরস্কার করবেন। তবে তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, সর্বোচ্চ ভালোবাসা এই যে, আল্লাহ ও রাসূল যা কিছু হুকুম দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত করা, তিনি যে দ্বীন এনেছেন, তাকে নিজের জীবন ব্যবস্থায় পরিণত করা। রাসূলের অনুকরণ অনুসরণই হলো রাসূল প্রীতির সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট রূপ যদি তা যথার্থ আন্তরিক ও রাসূলের প্রতি হৃদয়ের টান সহকারে করা হয়।
রাসূল প্রীতির ঝুঁকি
হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এল এবং সে রাসূল (সা.) কে বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি। তিনি বললেন, তুমি যে কথাটা বললে, তা নিয়ে আরো একটু চিন্তাভাবনা কর। এরপরও সে তিনবার বললো যে, আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে ভালোবাসি। রাসূল (সা.) বললেন তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দারিদ্রের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হও। কেননা যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, তার কাছে অভাব ও ক্ষুধা স্রোতের পানির চেয়েও দ্রুতবেগে আসে। [তিরমিযি]
কাউকে ভালোবাসার অর্থ এটাই হয়ে থাকে যে, সে যা পছন্দ করে তাই পছন্দ করতে হবে এবং সে যা অপছন্দ করে তা অপছন্দ করতে হবে, প্রিয় ব্যক্তি যে পথে চলে সেই পথে চলতে হবে। তার নৈকট্য, ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির খাতিরে সমস্ত প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে হবে ও কুরবানী করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
রাসূল (সা.) কে ভালোবাসা ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ হলো, তিনি যে পথে চলেছেন, সে পথের যাবতীয় চিহ্ন ও রূপরেখা সঠিকভাবে জেনে ও মেনে সেই পথে চলতে হবে। যে পথে চলতে গিয়ে তিনি আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, দুঃখকষ্ট ও মুসিবত ভোগ করেছেন, শত আঘাত ও মুসিবত সহ্য করেও সেই পথে ছলার হিম্মত ও সাহস অর্জন করতে হবে। এই পথে কখনো হেরা গুহারও সাক্ষাত মিলবে, বদর হুনায়েনের মুখোমুখি হতে হবে।
আল্লাহর দ্বীন অনুসারে চলতে গেলে অভাব ও ক্ষুধার মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আর অর্থনৈতিক আঘাতটাই যে সবচেয়ে দুঃসহ আঘাত, তা সবাই জানে। এ আঘাতের মোকাবিলা কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা ও আল্লাহর ভালোবাসার অস্ত্র দিয়েই করা সম্ভব। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি এরকম পরিস্থিতিতে ভাবে যে, আমার অভিভাবক তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, সুতরাং আমি অসহায় নই। আমিতো তার দাস। দাসের একমাত্র কাজ হলো মনিবকে খুশি করা ও তার ইচ্ছা পূরণ করা। আমি যার কাজে নিয়োজিত, তিনি দয়ালু ও ন্যায়বিচারক। সুতরাং আমার শ্রম বৃথা যেতে পারে না। তার এ ধরনের চিন্তা সমস্ত বিপদ মুসিবতকে সহজ করে দেয় এবং শয়তানের যাবতীয় অস্ত্রকে ভোতা করে দেয়