সিএনজিতেই তাসফিয়া,কে ধর্ষণের পর হত্যা ?
সিএনজিতেই তাসফিয়াকে- হত্যা’ নাকি ‘আত্মহত্যা’? তাসফিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে এ দুটো প্রশ্ন আছে তার লাশ উদ্ধারের পর থেকেই। প্রশ্নগুলোর উত্তর সোমবার পর্যন্ত দিতে পারেনি পুলিশও। যদিও তাকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে বলেই দাবি করেন তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন। মরদেহ উদ্ধারের পর চোখ, মুখ, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘নির্যাতন করেই তার মেয়েকে খুন করা হয়েছে’।
হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি ও তাসফিয়ার ‘প্রেমিক’ আদনান মির্জা। তার পরিবার বলছে, তারাও চান তাসফিয়ার মৃত্যু রহস্য খোলাসা হোক। তবে এ ঘটনায় আদনানের সম্পৃক্ততা নেই বলেও দাবি করেন তারা। তবে কেউ কেউ তাসফিয়ার মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলেই প্রচার করে আসছে। এমনকি লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের পক্ষেও ‘আত্মহত্যা’ বলে ধারণা করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, তাসফিয়ার মৃত্যু নিয়ে চট্টগ্রাম তো বটেই, সারাদেশেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। পুরো বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ আছে, কৌতূহল আছে। আছে নানা প্রশ্নও। প্রশ্ন উঠেছে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলা আঁধারে হারিয়ে যাবে, নাকি বিচারের পথ খুঁজে পাবে তা নিয়েও। এদিকে তাসফিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে আরো কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর গত ৩ মে তার বাবা পতেঙ্গা থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এর মধ্যে আদনান ছাড়া অন্য কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ওই হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি সোহেল (১৬)। সে তাসফিয়ার ক্লাসমেট। মঙ্গলবার রাত থেকে আত্মগোপনে আছে সোহেলও। এই সোহেলের মাধ্যমেই তাসফিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আদনানের। নগরীর কাতালগঞ্জের ১ নম্বর রোডের বাসিন্দা সোহেলকে আটক করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কিন্তু পুলিশ এই ক্ষেত্রে ‘উদাসীন’ বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এদিকে সোহেলের বন্ধু এবং মামলার তিন নম্বর আসামি শওকাত মিরাজও আত্মগোপনে। প্রসঙ্গত, গত ২ মে পতেঙ্গা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে সানসাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের মরদেহ। পরদিন তাসফিয়ার বাবা একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পতেঙ্গা থানায়।
অবশ্য ১ মে সন্ধ্যা থেকেই নিখোঁজ ছিল তাসফিয়া। পরে গোলপাহাড়ের মোড়ে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ‘চায়না গ্রিল’ থেকে একটি সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়। এতে দেখা যায়, ‘১ মে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে প্রবেশ করে তাসফিয়া ও আদনান।
সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিটে তাসফিয়া ও আদনানকে একসঙ্গে বের হতে দেখা যায়। এ সময় আদনানকে বিল দিতেও দেখা যায়।’ মূলত, এই ভিডিও ফুটেজ পাওয়ার পর তাসফিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে আদনানের কোন ধরনের যোগসূত্র রয়েছে কী না সেই প্রশ্ন ওঠে। অবশ্য ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে আদনানকে।
তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাসফিয়াকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পায়চারি করতে দেখেছিল একজন ম্যাজিস্ট্রেটের শ্যালক।’ যদিও ভিডিও ফুটেজ প্রমাণ করে, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তাসফিয়া গোল পাহাড়ের চায়না গ্রিলেই ছিল।
পরে অবশ্য পুলিশের বক্তব্য ছিল, ‘কয়েকজন যুবক মঙ্গলবার রাতে পতেঙ্গায় দেখতে পেয়েছিল তাসফিয়াকে’। ওই জায়গা থেকে আবার প্রশ্ন উঠেছে। কারণ আদনানের বক্তব্য ছিল, ‘চায়না গ্রিল থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার জন্যই সে গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল।’ সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে পতেঙ্গা কিভাবে পৌঁছে তাসফিয়া?
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘চায়না গ্রিল থেকে বের হওয়ার সময় সিসি ক্যামেরায় দুইজনের মধ্যে দূরত্ব লক্ষ্য করা যায় নি। রেস্টেুরেন্টের ভেতরে আদনান ও তাসফিয়ার মধ্যে যদি আত্মহত্যা করার মতো মনোমালিন্য হতো তাহলে তা বের হওয়ার সময় তাদের আচরণে কোন না কোনভাবে তা প্রকাশ পেত।’
উদাহারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুইজন দুইদিকেই চলে যায়। তাসফিয়া রাগ করে হয়ত আগেভাগেই বেরিয়ে যেত। এরপর আদনানও সমূহ বিপদের আশংকা করে তাসফিয়ার পরিবারের সদস্যদেরকে বিষয়টি আগেভাগেই জানিয়ে দিত। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং আদনান তাসফিয়াকে সিএনজি টেক্সি ভাড়া করে দিয়েছে।’ সেই সিএনজি টেক্সি কোথায় গেল সেই প্রশ্নের উত্তরও আদনানের কাছে রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে লাশ উদ্ধারের পর তাসফিয়ার শরীরে যে পোশাক ছিল তার সঙ্গে চায়না গ্রিলে অবস্থানের সময়কার কাপড়ের সঙ্গে অমিল রয়েছে বলেও বলছেন অনেকে। ওই জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ‘পোশাক কোথায় পরিবর্তন করেছে তাসফিয়া?’
তাসফিয়ার বাবার বক্তব্য : তাসফিয়ার মৃত্যুকে কেউ কেউ ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচার করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাসফিয়ার পিতা মো. আমিন বলেন, ‘আত্মহত্যা নয়, আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এটা তো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। তাসফিয়ার দুই পায়ে বড় বড় জখম ছিল। দুই চোখে জখম।
সমস্ত শরীরে আঘাতের চিহ্ন। পুরো মুখটা থেতলে গেছে। চেহারা স্বাভাবিক ছিল না। আঘাতের বিষয়গুলো সুরতহাল রির্পোটেও আছে। কেউ চাইলে অস্বীকার করতে পারবে না। এসব লক্ষণের পরেও কিভাবে আত্মহত্যা বলে প্রচার হচ্ছে? এটা কোনভাবেই আত্মহত্যা হতে পারে না। আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।’
তাসফিয়ার বাবা বাদি হয়ে যে হত্যা মামলা দায়ের করেন সেখানে দুই ও তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে সানশাইন স্কুলের ছাত্র মো. সোহেল ও মিরাজকে। সোহেলের সঙ্গে তাসফিয়ার যোগাযোগ ছিল কী না জানতে চাইলে তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন বলেন, ‘সোহেল তাসফিয়ার ক্লাসমেট। সে আদনানের কাজিন পরিচয় দিয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে তাসফিয়ার যখন খোঁজ করছিলাম তখন সোহেলও সাথে ছিল।’
সোহেলকে মামলার আসামী করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদানানের সঙ্গে ফার্স্ট টু লাস্ট পর্যন্ত সোহেল ছিল। তাকে তো সন্দেহ করতেই হবে। তাকে মামলার আসামী করতে হবে না?’
‘লাশ উদ্ধারের সময় তাসফিয়ার শরীরে যে পোশাক ছিল তার সঙ্গে ভিডিও ফুটেজের (চায়না গ্রিলে আদনানের সঙ্গে তাসফিয়াকে দেখা যাওয়ার ভিডিও) কাপড়ের মিল ছিল না বলেও অনেকেই বলছেন। এমনকি আদনানের পরিবার থেকেও গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পোশাকে ভিন্নতা ছিল’।
ফলে ওই জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠেছে, আদনানের কাছ থেকে আলাদা হওয়ার পর তাসফিয়া কি কোথাও পোশাক পরিবর্তন করেছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাসফিয়ার বাবা বলেন, ‘পোশাক সেম (একই) ছিল। ভিডিও ফুটেজে তাসফিয়াকে যে পোশাকে দেখা গেছে লাশ উদ্ধারের সময়েও একই পোশাকে ছিল। কোন পরিবর্তন হয় নাই।’
বিভিন্ন খবরে বলা হয়, মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানার পর আদনানকে বাসায় ডেকে এনে শাসিয়েছিলেন তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন। এ জায়গা থেকে আদনানের পরিবারের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আদনান কোন দোষ করলে অবিভাবকদের জানানো উচিত ছিল।
কিন্তু বাসায় ডেকে নিয়ে কেন শাসাবে? আবার কেউ কেউ এই শাসনোকে ঘিরে আদনান ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কী না সেই প্রশ্নও তুলেছেন। ‘আসলেই কি আদনানকে বাসায় ডেকে নিয়ে শাসিয়েছিলেন?’ এমন প্রশ্নে তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন বলেন, ‘এ তথ্য দিয়েছে উনার (আদনানের বাবা) ছেলে (আদনান)। আমি কখনো শাসায়নি। বাসায়ও ডেকে আনিনি।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তসফিয়াকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আদনানকে ‘বাসায় ডেকে এনে আটকে রাখেন মো. আমিন। পরে কথিত যুবলীগ নেতা ফিরোজ (তাসফিয়া হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামী) এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।’
এমন একটি তথ্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন বলেন, ‘বাসায় আনিনি। তাসফিয়ার বন্ধুদের কাছ থেকে আদনানের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কল করি। ওআর নিজাম রোডে রাস্তায় কথা বলি। আদনান এসে বলে, ‘সে তাসফিয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে’।
পরে আদনানই তার বড় ভাই একরামকে (৫ নম্বর আসামী) কল করে আনে। একরাম এসে বলে, ‘আধ ঘণ্টার মধ্যে তাসফিয়াকে এনে দেবে।’ পরে একরামই ফিরোজের কাছে নিয়ে যায়। তখন ফিরোজ বলে, ‘কোন সমস্য হবে না। আদনানের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’
আদনানের পরিবারের বক্তব্য : তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এরমধ্যে সর্বশেষ তাসফিয়াকে দেখা যায় চায়না গ্রিল রেস্টুরেন্ট থেকে উদ্ধার হওয়া ভিডিও ফুটেজে।
ওই ভিডিওতে তাসফিয়ার সঙ্গে তার ‘প্রেমিক’ আদনানও আছে। তাসফিয়াকে সিএনজি টেক্সিতে তুলে দিয়েছিল আদনান। মূলত, এর পর থেকেই নিখাঁজ হয় তাসফিয়া। পরদিন বুধবার তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর তার বাবা বাদী হয়ে যে মামলা দায়ের করেন সেখানে এক নম্বর আসামী করা হয় আদনানকে।
অবশ্য আদনানের পরিবার দাবি করে আসছে ‘আদনান নির্দোষ’। ইতোমধ্যে আদনানের বাবা ইসকান্দর মির্জা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরাও চাই তাসফিয়ার মৃত্যু রহস্য উন্মোচন হোক। যত তাড়াতাড়ি তার মৃত্যুর রহস্য উম্মোচন হবে, তত তাড়াতাড়ি আমার ছেলে ছাড়া পাবে। কারণ, আমার ছেলে নির্দোষ।’
এদিকে সোমবার আদনানের বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ভাই (আদনানের চাচা) সোহেল মির্জা জানান, আদনানের বাবা অসুস্থ। কোন প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর তিনি দেবেন। এসময় তাসফিয়ার সঙ্গে আদনানের ‘প্রেমের সম্পর্কে’র বিষয়টি আদনানের বাবা জানতেন কী না জানতে চাইলে সোহেল মির্জা বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমরা জানতাম না।
এমনকি আদনানের গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা বাসার ভিডিও ফুটেজে দেখেছি, ‘বুধবার বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে ফোন পেয়ে বের হয় আদনান। সে দ্রুত যাচ্ছিল। তাঁর হেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল না। পরে মিরাজ ফোন করে জানায়, ‘আদনান গ্রেপ্তার হয়েছে।’
‘মঙ্গলবার রাতেও আদনান তাসফিয়াকে খুঁজছিল তার বাবার সঙ্গে। এ বিষয়টিও কি জানতেন না?’ এমন প্রশো্ন সোহেল মির্জা বলেন, ‘আদনান, মিরাজ, সোহেল সবাই খুঁজেছে। আদনান যে খুঁজছে সেটা জানতাম না।
আমরা আদনানের সঙ্গে কথা বলেছি, সে বলেছে– ‘তাসফিয়ার সঙ্গে যখন সে চায়না গ্রিল রেস্টুরেন্টে ছিল তখন সোহেল ফোন দেয় আদনানকে। তখন সোহেল ফোনে আদনানকে বলেছিল, ‘তোরা কোথায়? তাসফিয়ার মা কল করেছেন তাসফিয়ার বিষয়ে জানতে।’ পরে তাসফিয়াকে গাড়িতে তুলে দেয় আদনান।’
‘আদনানের বাবা ওই সোহেলকেই সন্দেহ করে বক্তব্য দিয়েছেন গণমাধ্যমে। সোহেলকে সন্দেহ করার কারণ কি?’ এমন প্রশ্নে আদনানের চাচা বলেন, ‘প্রথমত সোহেলই ফোন করেছিল আদনানকে। এই সোহেলের ফোনের উপর ভিত্তি করেই সে তাসফিয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে সোহেলের মোবাইল ফোনও বন্ধ। অবশ্য মিরাজের (তাসফিয়া হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামী) ফোন কয়েক ঘন্টা অন ছিল।’
আদনানের চাচা বলেন, ‘আদনান আমাদেরকে জানিয়েছে, তার কাছ থেকে তাসফিয়া ১০০ টাকা খুঁজে নিয়েছিল। বাসায় যাওয়ার আগে এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। ওই বান্ধবীর বাসা তাসফিয়াদের বাসায় যাওয়ার রাস্তাতেই।’
প্রসঙ্গক্রমে আদনানের চাচা সোহেল মির্জা বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে তাসফিয়ার বাবাকে প্রশ্ন করতে চাই, বন্ধু–বান্ধবী (আদনান ও তাসফিয়া) মিলে নাস্তা করতেই পারে। এটা কি দোষের? তাছাড়া গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি, ‘তাদের মধ্যে এক মাসের সম্পর্ক ছিল। আমাদের ছেলে যদি কোন ধরনের ডিস্টার্ব করে থাকে তাহলে অবিভাবক হিসেবে আমাদের জানায়নি কেন? বাসায় ডেকে নিয়ে শাসাতে হবে কেন?’
‘তাসফিয়ার মৃত্যু নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য আছে। ‘হত্যা’ এবং ‘আত্মহত্যা’। আদনানকে হত্যা মামলার আসামীও করা হয়েছে। তবে আপনারা কোনটি মনে করেন?’ এমন প্রশ্নে আদনানের চাচা বলেন, ‘এটা আমরা বলতে পারবো না। আমরাও চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আসল রহস্য উন্মোচিত হোক। আদনান খুনি হলে ওই রাতে (মঙ্গলবার রাত।
যে রাতে তাসফিয়াকে তার বাবার সঙ্গে খুঁজছিলেন আদনান) কেন তাকে পুলিশে দেয়নি? আসলে পুরো ঘটনাটাই রহস্যজনক। পত্রপত্রিকায় তো এসেছে, লাশের কাপড় পরিবর্তন হয়েছে। এই ড্রেস কোথায় গিয়ে চেঞ্জ করল? আমাদের ছেলে যদি খুন করতো তাহলে সে তো তাসফিয়াকে খুঁজতে যেত না।’
আদনানকে বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি উল্লেখ করে আদনানের চাচা বলেন, ‘আদনানকে মিরাজ কল করেছিল। এরপর সে মুরাদপুর যায়। সেখান থেকে নাসিরাবাদ আসে। নাসিরাবাদে আসাদ নামে একজন আদনানকে নিয়ে মির্জাপুল যায়। মির্জাপুলে অবস্থানরত একটি কালো রঙের ‘হাইচ’ (মাইক্রো) গাড়িতে সে আদনানকে তুলে দেয়। সেখানে পুলিশ ছিল।’ এ সময় আদনানের চাচা প্রশ্ন করেন, ‘এই আসাদ কে? তার পরিচয়ই বা কি?’
সেই ফিরোজ যা বললেন : তাসফিয়া হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামী কথিত যুবলীগ নেতা ফিরোজ। ‘মেয়ে নিঁেখাজ হওয়ার পর আদনানকে বাসায় ডেকে নিয়ে আটকে রেখেছিল তাসফিয়ার বাবা।
এরপর ফিরোজ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়’ণ্ড এমন তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে ইতোমধ্যে। ফিরোজ সোমবার বলেন, “আদনানের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। ইকরামের (তাসফিয়া হত্যা মামলার ৫ নম্বর আসামী ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম) মাধ্যমে আসিফের (৪ নম্বর আসামী আসিফ মিজান) সঙ্গে পরিচয় হয়।
আসিফের ‘ছোট ভাই’ (স্কুলের দিক দিয়ে) আদনান। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটা, নয়টার দিকে আসিফ আদনানকে নিয়ে আসে মুরাদপুর। তাসফিয়ার চাচাও ছিল সেখানে। তখন আদনান আমাকে জানায়, ‘তাসফিয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে সে।’
এসময় আমি তাসফিয়ার চাচাকে বলেছিলাম, ‘আদনান যদি দোষী হয় তাহলে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব।’ পরদিন বুধবার তাসফিয়ার লাশ পাওয়ার পর, এক বন্ধুর মাধ্যমে আদনানকে পুলিশের হাতে তুলে দিই। পুরো ঘটনার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা এতটুকুই।”
প্রশাসনের বক্তব্য : তাসফিয়া হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপি’র কর্ণফুলী জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটি আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে তদন্ত করছি। এরই অংশ হিসেবে ‘ভিসেরা রিপোর্ট’সহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য ঢাকাস্থ সিআইডির ল্যাবে এ সংক্রান্ত সেম্পল পাঠানো হয়েছে ইতোমধ্যে।’
‘তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব আমার কাছে। অপরাধী যেই–ই হোক বাঁচতে পারবে না।’
তাসফিয়া হত্যা মামলায় আদনান ছাড়া অন্যকোন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে থানার (পতেঙ্গা) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবহিত আছেন।’ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই আসামিদের গ্রেপ্তারের মূল দায়িত্বে রয়েছেন বলেও জানান সিএমপির এ কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, ‘ফরেনসিক মেডিসিনে ভিসেরা পরীক্ষা করা হয় লিভার ও কিডনির। এ পরীক্ষার মাধ্যমে কারো মৃত্যু বিষ প্রয়োগ হয়েছে কি না, আর সেই বিষ প্রয়োগ করলে সেটি কী ধরনের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে তার পরীক্ষা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাসফিয়া হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পতেঙ্গা থানার এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা মামলার একটা ফলাফল পেয়ে গেছি। শুধু একটা বিষয় যাচাই–বাছাই করে দেখছি।
আপ্রাণ চেষ্টায় আছি আসামিদেরকে ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসার। আশা করছি দুই একদিনের মধ্যেই আসামিদের আইনের আওতায় আনতে পারবো।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাসফিয়ার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’ এখনও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যায় নি বলেও জানান তিনি।
আইনজীবীর বক্তব্য : তাসফিয়া হত্যা মামলার বিষয়ে অতিরিক্ত মহানগর পিপি এডভোকেট আকতারুন নেসা বেগম বলেন, ‘গোল পাহাড়ের মোড় (চায়না গ্রিল) থেকে ওআর, নিজাম রোডে তাসফিয়ার বাসার দূরত্ব কয়েকশ’ গজের বেশি হবে না। স্বল্প এই দূরত্ব সিএনজি টেক্সিতে না গিয়ে তাসফিয়া হেটেও যেতে পারতো। এখানে প্রশ্ন আসে, কার ইশারায় স্বল্প দূরত্বের পথ যেতে সিএনজি টেক্সি নেয়া হয়েছিল?’
তিনি আরো বলেন, ‘সিএনজি টেক্সিটি সর্বশেষ কতদুর পর্যন্ত গিয়েছিল। মাঝপথ থেকে সিএনজি টেক্সিতে আর কেউ উঠেছিল কিনা? এখানে সিএনজি টেক্সি ও তার ড্রাইভারকে অবশ্যই চাই। এ সিএনজিতেই হয়তো তাসফিয়াকে হত্যা করা হতে পারে। পরে পতেঙ্গা সৈকতে গিয়ে তার লাশ ফেলে দেয়া হয়।’ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ধর্ষণের মত ঘটনাও থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ আইনজীবী।
মামলার এজাহারে আঘাতের কথা: উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তাসফিয়া আমিনের লাশ পতেঙ্গা সৈকত থেকে উদ্ধার করার সময় পুলিশ, তার পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে।
এসময় তাসফিয়ার ডান চোখের উপরে, বাম চোখে, নাকে, ঠোঁঠে থেতলানো জখম, মুখমণ্ডলে ভারী কোন অস্ত্র দ্বারা উপর্যুপরি আঘাতের মাধ্যমে গুরুতর জখম, দুই হাঁটু ও হাঁটুর নিচে মোচড়ানো জখম ও মুখমণ্ডল রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এজাহারে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী তাসফিয়ার শরীরের অধিকাংশ স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ আঘাত এ ঘটনাকে হত্যাকাণ্ডের দিকেই ইঙ্গিত করে।
আদনান ও তাসফিয়ার বাবার পরিচয় : তাসফিয়া কক্সবাজার জেলার টেকনাফের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা মো. আমিনের মেয়ে। মো. আমিন বর্তমানে পরিবার নিয়ে নগরীর ও আর নিজাম রোডে থাকেন। তাসফিয়ার বাবা একজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী।
আদনান লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নের ইসকান্দর মির্জার ছেলে। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন ইসকান্দর মির্জা। নগরীর খুলশী থানার দক্ষিণে জালালাবাদ আবাসিকের রয়েল পার্ক বিল্ডিংয়ে তারা থাকেন। এসএস ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস নামে ইসকান্দর মির্জার ট্যাভেল এজেন্সি রয়েছে।