বেতাগীতে খোলা আকাশের নীচে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাশ ও পরিক্ষা

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১১:৪৩ এএম, ৬ মে ২০১৮

খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া হচ্ছেতরিকুল রিয়াজ, বরগুনাঃ
একটি উঠানে খোল আকাশের নিচে বসে পরিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা এমন সময় কালবৈশাখী ঝড়। দৌড়ে পাশের ছোট্ট ঘরটিতে আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সকলে। এমন করেই প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে চলছে বেতাগী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের ভাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ ও প্রথম সাময়িকি পরিক্ষা।

বেতাগী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের ভাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় পরিত্যাক্ত ঘোষনা করে উপজেলা প্রকৌশুলী। যে কোন সময় ভেঙ্গে পারে ঘটতে পারে মারার্ত্বক দূর্ঘটনা। ২৩ এপ্রিল থেকে ব্যবহার করছে না এই বিদ্যালয়ের ভবনটি। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাশসহ প্রথম সাময়িকি পরিক্ষা দিতে হয়েছে খোলা আকাশের নিচে বসে। অস্বাভাবিক গরমের মধ্যে বসে পরিক্ষা দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে কয়েকজন শিক্ষার্থীরা।

গত সোমবার (৩০ এপ্রিল) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের পাশের একটি বাড়ীর উঠানে খোলা আকাশের নীচে রোদের মধ্যে প্রচন্ড গরমে পরীক্ষা দিচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীর পরিক্ষা শেষ হয়। পরে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেনীর পরিক্ষা শুরুর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে এমন সময় হঠাৎ করে শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। শিক্ষকরা দ্রুত শিক্ষার্থীদেরকে পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য নির্দ্দেশ করেন। ঘরের মধ্যে চট বিছিয়ে শিক্ষার্থীদের বসে থকেতে হয় বৃষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত। তার পরে দিয়েছে পরিক্ষা। এমন করেই গত কয়েক দিন ধরে ভাসান্ড আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর চলছে ভোগান্তি।

বেতাগী সুবিদখালী মহাসড়কের পার্শে অবস্থিত ভাসান্ড আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৭ জন নারী শিক্ষক ও ১৩১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
বিদ্যালয়ের ভবন ঝুকিপূর্ন থাকায় বাহিরে কোথায় ক্লাশ ও পরিক্ষা নেয়া হবে এনিয়ে বিপদে পরতে হয় শিক্ষকদের। পরে স্কুলের পাশের বাড়ীর সুধংস শেখর হাওলাদার ও তার স্ত্রী এই শিক্ষা অনুরাগী দম্পত্তি এগিয়ে আসে শিক্ষার্থীদের জন্য। তিনি তার উঠান ছেড়ে দিয়েছে বিদ্যালয়ের ক্লাশ ও পরিক্ষার জন্য। এমনি কি শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য তার ঘরও ছেড়ে দিচ্ছেন স্কুল চলাকালিন সময়ে।

সুধংস শেখর হাওলাদার বলেন, আমার সন্তানও এই বিদ্যালয়ে একসময় লেখা পড়া করতো। এই যে শিশুরা তারও তো আমার সন্তানের মত। আমি যে ভাবে পারছি তাদের সহযোগীতা করছি। যেন এখানে ক্লাশ বা পরিক্ষা দিতে কোন সমস্যা না হয়। তিনি আক্ষেপ নিয়ে আরো বলেন, আমি গরিব মানুষ কিন্তু আমার যে উঠান আছে সেখাই ওদের জায়গা দিয়েছি। অর্থ থাকলে আপাদত ক্লাশ করার জন্য একটি ঘর তুলে দিতাম।

সুধংস শেখর হাওলাদারের স্ত্রী বলেন, আমাদের এখানে কোন টিউবয়েল নেই। তাই শিক্ষার্থীদের পানি খেতে কষ্ট হয়। এছাড়া আমরা মোটামুটি সকল সহযোগীতা করতে পারছি।

এর আগে গরমের কারনে অসুস্থ হয়েছে কয়েকজন শিক্ষাথী। প্রথম শ্রেণির মাহি, তৃতীয় শ্রেণির লামিয়া ও পঞ্চম শ্রেনির শিক্ষার্থী মো: সোলায়মান জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রথম দিনের পরীক্ষার পর থেকে অনুপস্থিত রয়েছে।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতি বেগম বলেন, স্কুলের বাইরে পরীক্ষা দিতে আমাদের কস্ট হচ্ছে।

পঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থী সহিদুল বলেন, বিদ্যালয় ভবনের উপরে হাটলে ভবন কাঁপে। ভেঙ্গে যেতে পারে তই এখন খোলা মাঠে পরিক্ষা দিচ্ছে। প্রচন্ড গরম এছাড়া হঠাৎ করে বৃষ্টি আসে। আমাদের অনেক কষ্ট হয়। আমাদের একটা বিদ্যালয় ভবন দরকার বলেও দাবী করেন এই শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন বলেন, এ রকম খোলা আকাশের নীচে পরীক্ষা দিতে কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের দারুন ভাবে কষ্ট হচ্ছে। তারা কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পরছে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে বেতাগী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডে ভাসন্ডা এলাকায় ১৮ শতাংশ জমির উপর বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয়। বিগত ২০০১ সালে ৪ কক্ষ বিশিষ্ট বর্তমান ভাবনটি নির্মাণ করা হয়। বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি নির্মানে ত্রুটি থাকায় ক’বছর যেতে না যেতেই ব্যবহারে ঝুকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে এ ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এমন সংবাদ প্রকাশের পরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে এ বিষয় বেতাগী উপজেলা প্রকৌশলীর নিকট একটি প্রতিদেন প্রদানের জন্য চিঠি প্রেরন করেন। সে অনুযায়ী চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ উপজেলা প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শন পূর্বক প্রয়োজণীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য দূর্ঘটনায় প্রাণ হানি ঘটতে পারে এই মর্মে বিদেোলয়র প্রধান শিক্ষকে বেতাগী থানায় ডায়েরীভুক্ত করার পরামর্শ দেন। পরামর্শ অনুয়ায়ী প্রধান শিক্ষক বেতাগী থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন। সাধারণ ডায়েরীর কপি, ছবি ও প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়।
বৃস্টিতে ঘরের মধ্যে ক্লাশ নেয়া হচ্ছে
৯ এপ্রিল উপজেলা প্রকৌশলী ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কার্যক্রম না চালানোর জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নিকট একটি চিঠি প্রেরন করেন। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। তাই আতঙ্ক নিয়ে বধ্য হয়ে ২৩ এপ্রিল থেকে বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বাড়ীর উঠনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় নেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিবাবক বলেন, ভবনটি কয়েক বছর ধরেই ঝুঁকিতে রয়েছে। একটু ঝড়ো বাতাস হলে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কায় দ্বিতীয় তলা থেকে শিক্ষার্থীদের নিচে নামিয়ে আনতে হয়। রাস্তা দিয়ে বড় কোন গাড়ী গেলে ভবনে কম্পন সৃষ্টি হয়। মনে হয় এখনি ভেঙ্গে পরবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ভবন করার কোন নাম নেই।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুসতারী আক্তার বলেন, শিশুরা উপর দিয়ে একটু দৌড় দিলে বা বড়রা কেউ হাটলে ভবন কাপে। অনেক সময় দেখা যায়, জোরে হাটলে টেবিলে রাখা বিভিন্ন জিনিস পত্র কাপতে কাপতে নিচে পার যায়।

এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কেয়া চৌধুরী জানান, খুব ভয় নিয়ে আমার ভবনটিতে ক্লাশ করতাম। এখন এটি ঝুঁকিপূর্ন তাই ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য বলা হয়েছে। একখন একটি উঠানে পরিক্ষা নিচ্ছি। এখানে তো অনেক গরম শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পরে। এর পরে বৃষ্টির মৌসুম আসছে জানিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোথায় যাবো।

বাসন্ডা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসা: সাঈদা পারভীন বলেন, ঝুঁকির কারনে আমরাও সাহস পাচ্ছিনা। তারপরেও বিকল্প ব্যবস্থা না করেই ভবন ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার কারনে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছি। সারাদিন খোলা আকাশের নীচে কাটাচ্ছি। যে কোন ভাবেই আমাদের পাঠদান চালাতে হবে। দ্রুত বিদ্যালয় ভবনের বাদী করে তিনি আরো বলেণ, এই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে একটা অস্থায়ী ঘরের দরকার।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বরগুনা জেলা পরিষদের সদস্য আবুল কাসেম ( বিএসসি ) বলেন, বিদ্যালয়ের নতুন ভবন হবে শুনি অনেক দিন থেকে। একবার মাটি পরিক্ষাও করা হয়েছে কিন্তু কোথায় কি কিছুই দেখিনা। এখন ঝুকিপূর্ন ভবনে ক্লাশ নিয়ে বিপদ হলে কে দায়ভার বহন করবে। তবে এখন খোলা আকাশের নিচে ছোট ছোট শিশুরা পরিক্ষা দিচ্ছে এটা খুব মর্মান্তিক। আমরা শিক্ষা অফিসসহ বেশ কয়েকটা অফিসে কথা বলেছি মুল ভবন করার আগে শিশুদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা জন্য।

বেতাগী উপজেলা প্রকৌশলী মো: সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহনের কোন ক্ষমতা আমাদের নেই। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে দুর্যোগ মৌসুম। তাই দূর্ঘটনা এড়াতে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।

এবিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভবনটি পরিদর্শন করেছি। এটি আসলেই অনেক ঝুকিতে রয়েছে। যে কোন সময় বিপদ ঘটতে পারে তাই ঐ অবস্থায় পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বাহিরেও শিশুরা অনেক কষ্ট করে পরিক্ষা দিচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভবনটি পুর্ননির্মানের জন্য উধর্তন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, খুব শিগ্রই বেতাগীর ভাসান্ডা আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতে যাবো। ইতোমধ্যে বেতাগী উপজেলা নিবার্হী কর্মমর্তাকে সরেজমিন পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অব্যহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও তিনি জানান।

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৬ মে

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)