হজরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দিঘির কুমিরটি দিঘির পাড়ে গর্ত খুঁড়ে ৬০-৭০টি ডিম পেড়েছে।

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ১২:৩৩ এএম, ১ মে ২০১৮

কুমির
অনলাইন ডেস্কঃ বাগেরহাটে হজরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দিঘির কুমির আবারও ডিম পেড়েছে। কয়েক দিন ধরে মাটির নিচে ডিম রেখে বাচ্চা ফোটানোর চেষ্টা করছে মাদি কুমিরটি। এর আগেও কয়েক বছর কুমিরটি ডিমে ‘তা’ দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছে। পরে ইনকিউবেটরে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় (কৃত্রিমভাবে) ডিম রেখে চেষ্টা করেও বাচ্চা ফোটানো যায়নি। ফলে প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ দিঘিটি কুমিরের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বৈশাখের প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দিঘির উত্তর পাড়ে একটি কুমির মাটি আঁকড়ে আছে। সেখানে গর্ত খুঁড়ে ডিম ঢেকে রেখেছে মাদি কুমিরটি। এখন বাচ্চা ফোটানোর জন্য তা দিচ্ছে। মানুষ ডিমের কাছে গেলেই তেড়ে আসছে কুমিরটি। তাই ওই স্থানটি বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কুমিরের ডিম পাড়ার কথা শুনে বিরল এ দৃশ্য দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড় অনেকটা বেড়েছে। কেউ কেউ আবার তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ায় কুমিরটির সামনে হাঁস-মুরগি ছুড়ে মারছে। তবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কুমিরকে কোনো হাঁস-মুরগি খেতে দেখা যায়নি।

জানা গেছে, হজরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দিঘিতে ‘কালাপাড়’ ও ‘ধলাপাড়’ নামে দুটি কুমির লালন-পালন করতেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই জুটির শেষ বংশধরটি মারা গেছে। বর্তমানে দিঘিতে কালাপাড় ও ধলাপাড়ের কোনো বংশধর নেই।

২০০৫ সালে ভারত সরকারের উপহার দেওয়া ৪০টির কুমিরছানার মধ্যে ছয়টি এ দিঘিতে ছাড়া হয়েছে। ওই সময়ে ছাড়া মাদি ও পুরুষ কুমির দুটিই এখন দিঘির শেষ সম্বল। মাদি কুমিরটি কয়েক বছর ধরে ডিম পাড়লেও বাচ্চা ফুটছে না। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিকভাবে চেষ্টা করেও বাচ্চা ফোটানো যায়নি।

মাজারের খাদেম আজাহার আলী জানান, গত ১৯ মার্চ কুমিরটি দিঘির পাড়ে গর্ত খুঁড়ে ৬০-৭০টি ডিম পেড়েছে। ওই ডিম ধুলামাটি দিয়ে ঢেকে বাচ্চা ফোটাতে তা দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে কুমিরটি দিঘিতে নামলেও আবার ছুটে আসছে ডিমের কাছে। আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত কুমিরটি ডিমে তা দেবে বলে ওই খাদেম জানান।

মাজারের প্রধান খাদেম শের আলী ফকির জানান, হজরত পীর খানজাহান (রহ.) এ দিঘিতে কালাপাড় ও ধলাপাড় নামে দুটি কুমির লালন-পালন করতেন। ওই জুটির কোনো বংশধর এখন আর বেঁচে নেই। এখন ভারত সরকারের দেওয়া দুটি কুমির দিঘির সম্বল। কয়েক বছর ধরে মাদি কুমিরটি ডিম পাড়লেও তাতে বাচ্চা ফুটছে না। কুমিরের বংশবৃদ্ধি না হলে দিঘিটি তার ৬০০ বছরের ঐতিহ্য হারাবে বলে অনেকেই মনে করছেন। তাই দিঘিতে কুমিরের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

সুমি আক্তার, আসমা বেগম, নমিতা রানী দাস, হোসেন শেখ, শহীদুল ইসমসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, তাঁদের বিশ্বাস দিঘির কুমিরের সামনে মানত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। সে বিশ্বাস নিয়েই বিভিন্ন সময় মাজারে আসেন তাঁরা। কুমিরকে হাঁস-মুরগি মানত দিয়েছেন। যাওয়ার সময় দিঘি থেকে পানি নিয়ে যাবেন। দিঘির কুমিরকে ঘিরেই তাঁদের আগ্রহ বেশি। তাই দিঘিতে কুমির সংরক্ষণের দাবি জানান তাঁরা।

বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সাইফুজ্জামান খান জানান, দিঘিতে একটি পুরুষ ও একটি মাদি কুমির রয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম—উভয়ভাবেই চেষ্টা করেও ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো যায়নি। মাদি কুমিরটিকে চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া হয়েছে। তাঁদের ধারণা, পুরুষ প্রজাতির কুমিরটির শুক্রাণু মাদি কুমিরটির ডিম্বাণুতে যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন হচ্ছে না। এ কারণে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মধ্যে অ্যাভুলেশনের ব্যত্যয় ঘটছে। তা ছাড়া শতভাগ সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় পুরুষ কুমিরটির শুক্রাণুর সক্ষমতা কমে যেতে পারে।

ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইলস নামের বাণিজ্যিক কুমির ফার্মের ব্যবস্থাপক কুমির বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ জানান, দিঘির ওই কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা না ফোটার পেছনে মাদি ও পুরুষ- উভয় কুমিরেরই বেশ কিছু সমস্যা থাকতে পারে। সাধারণত পুরুষ কুমির ১০-১২ ও মাদি কুমির ৮-১০ বছর বয়সে প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। সেদিক থেকে দুটি কুমিরই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই জরুরি ভিত্তিতে ওই কুমির দুটির চিকিৎসা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক উপায়ে চেষ্টা না করে কৃত্রিমভাবে বাচ্চা ফোটানোর পক্ষে মত দেন ওই কুমির বিশেষজ্ঞ। স্বাভাবিক পরিবেশ পেলে একটি কুমির ৮০ থেকে ১০০ বছর বাঁচে বলে জানান তিনি।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, কুমির দিঘির ঐতিহ্য। কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য কয়েক বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ বিভাগের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। কী কারণে বাচ্চা ফুটছে না তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে দিঘির ঐতিহ্য ধরে রাখতে কুমিরের বংশবৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তাই ইতিমধ্যে দিঘি থেকে দুটি কুমির সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। করমজল থেকে কুমির এনে দিঘিতে সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।

ইতিহাস থেকে জানা গেছে, হজরত খানজাহান (রহ.) সুলতানি শাসন আমলে ১৪০০ সালের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে আসেন। বাগেরহাটে খলিফাতাবাদ নগর প্রতিষ্ঠা করেন। হজরত খানজাহান দক্ষিণবঙ্গের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি অসংখ্য জলাশয় খনন করে মানুষের কষ্ট দূর করেছেন। এ সময় তিনি ঠাকুর দিঘি নামে পরিচিত ৩৬০ বিঘা জমির ওপর বিশাল এই দিঘি খনন করেন। পরে তা খাঞ্জেলী দিঘি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ওই দিঘির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় সমান। দিঘিতে তিনি কালাপাড় ও ধলাপাড় নামে দুটি কুমির লালন-পালন করতেন। দিঘির উত্তর পাড়ে রয়েছে খানজাহানের মাজার।
এ এম বি । পাথরঘাটা নিউজ । সুত্রঃ কালেরকন্ঠ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)