সাইবার অপরাধএক বছরে ৪০ হাজার অভিযোগ
ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় তাকেই সাইবার ক্রাইম বা প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ বলা হয়।
সাইবার অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে, উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধকে অপরাধের তালিকায় শীর্ষে স্থান দেয়া হয়েছে তৈরি করা হয়েছে সাইবার অপরাধীদের জন্য নতুন নতুন আইন এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখছেন -সাইফুল আহমাদ
বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইমের পরিচিতি বা এ সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনটি অনেকেরই জানা নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ আমাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়।
এ আইনে ইন্টারনেট অর্থ এমন একটি আন্তর্জাতিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে কম্পিউটার, সেলুলার ফোন বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহারকারীরা বিশ্বব্যাপী একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্যের আদান-প্রদান এবং ওয়েবসাইটে উপস্থাপিত তথ্য অবলোকন করতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, (১) যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জানা সত্ত্বেও এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্যবিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
(২)এমন কোনো কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন যাতে তিনি মালিক বা দখলদার নন, তাহলে তার এ কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ।
কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা উভয় দণ্ড দেয়া যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।
এত আইন এবং ধারা থাকা সত্ত্বে সাইবার অপরাধের সংখ্যা দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে। শুধু ২০১৭ সালে রাজধানীতে পুলিশের কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে অন্তত ৪০ হাজার।
এ অভিযোগগুলোর মধ্যে পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমেই শুধু অভিযোগ এসেছে ৫ হাজার ৮৪২টি। অভিযোগগুলোর মধ্যে ফেসবুক ভিত্তিক অপরাধের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট সূত্র।
কিন্তু একেকটি অভিযোগের সুরাহা করতেই অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। আর সে কারণে অভিযোগ নিষ্পত্তি করার হারও খুব একটা বেশি নয় বলে জানিয়েছেন ডিএমিপির এক কর্মকর্তা।
প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদ সরবরাহকারী জায়া
ন্ট টেকশহর থেকে জানা যায়, প্রতিদিন রাজধানীর অর্ধশত থানায় গড়ে তিন-চারটা অভিযোগ আসে। আবার থানার বাইরেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এবং টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের হেল্প ডেস্কেও দেদার অভিযোগ জমা হচ্ছে।
ফলে এ বিপুল সংখ্যক অভিযোগের সুরাহা কিভাবে হবে, এর কোনো নির্দেশনা নেই। পুলিশ নিজেদের মতো করে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বলছিলেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে।
সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে পুলিশের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে একটি সাইবার হেল্প ডেস্ক রয়েছে। এই ডেস্কে গত দুই বছরে ১৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে কাট আউট ছবি, অর্থাৎ একজনের নগ্ন ছবির ওপর আরেকজনের মুখজুড়ে দেয়া এবং পর্নোগ্রাফির অভিযোগই সবচেয়ে বেশি।
তাছাড়া ইউটিউব ও বিভিন্ন সাইটে এসব পর্নোগ্রাফি ও ছবি ‘আপলোড’ করার হারও অনেক বেশি। এ সংক্রান্ত অভিযোগে পুলিশের গ্রেফতারের হারও নেহাত কম নয়। ২০১৭ সালে এসব অভিযোগে ৭২ জনকে গ্রেফতার করে ডিএমপি।
তাছাড়া চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আরও ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে তারা। সম্প্রতি জাতীয় সংসেদ এমন হিসেব তুলে ধরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে কিছু অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ ফেসবুককে জানালেও তার সবকটিতে আবার তারা সাড়া দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
গত বছর এমন ৪৪টি ই-মেইল করা হলেও ফেসবুক সাড়া দিয়েছে ২৩টিতে। পুলিশ বলছে, অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করলে মূলত ভুয়া আইডির মাধ্যমে অপরাধ সংগঠনের বিষয়টিই বেশি চোখে পড়ে। আর এ কারণে অনেক সময় অপরাধীকে ধরাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
সাইবার ক্রাইম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, বর্তমানে ৫ শতাধিক সাইবার অপরাধ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মোট মামলার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মামলা হয়েছে আইসিটির ৫৭ ধারায়।
বাকি মামলাগুলো হয়েছে ৫৪, ৫৫, ৫৬ এবং ৬৬ ধারায়। মাত্র ১৫টি মামলা হয়েছে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি সংক্রান্ত বিষয়ে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭৬৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৫টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।
সরকারি কৌঁসুলি এসব মামলায় অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে তদন্তের জন্য একটি বিশেষ ইউনিট নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর মধ্যেই সাইবার ক্রাইম মামলা যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য একটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেটিভ ব্যুরো গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
পুলিশের সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে আইসিটি আইনে এক হাজার ৪১৭টি মামলা হয়েছে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি সাইবার অপরাধ কমাতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
আর অবশ্যই আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আইনের প্রচার বাড়াতে হবে এবং সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
পাথরঘাটা নিউজ/এজেআর/ ২৩ এপ্রিল