বিপদমুখি প্রবাসী বাংলাদেশী,রা সত্যটা ধামাচাপা হয়ে আছে।
বাংলাদেশের গর্বের সবচেয়ে বড় জায়গাগুলির একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। এই রেমিট্যান্স রিজার্ভের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান খুব নির্দিষ্ট করে বললে দুই শ্রেণীর মানুষের। এক দল হলেন , খেটে খাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক যাদের তৈরি পোষাকের কারণে বিশ্ববাজারে তৈরি পোষাক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড নাম্বার ওয়ান। আরেক শ্রেণী যাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশী তারা হলেন, পরিবার পরিজন ফেলে বিদেশ পাড়ি দেওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো, যাদের ঘামের মজুরের অর্থনীতি বাংলাদেশের অহংকার । সরকারি হিসাবে সারা বিশ্বের ১৬৫ টি দেশে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কর্মরত আছেন। তবে অনেকের মতে এই প্রবাসীদের সত্যিকার সংখ্যা দেড় কোটির বেশি হবে। এই প্রবাসীরা বাংলাদেশে তাদের আত্বীয় স্বজনদের কাছে বিপুল অংকের রেমিট্যান্স পাঠান। দীর্ঘদিন ধরে এই রেমিট্যান্সে শীর্ষে আছে সৌদি আরবের প্রবাসীরা।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানান, সৌদিআরব থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ হাজার ১১৮ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৪৫ দশমিক ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৫৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৬৭ দশমিক ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এক হাজার ২০২ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
এই ক্রমহ্রাসমান রেমিট্যান্স হারের পিছনে অনেকগুলি কারণকে একসাথে করে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং অত্যাধিক জনপ্রিয় হওয়া এর একটি কারণ। অবৈধ হুন্ডি ব্যাবসায়ীরা এই মোবাইল ব্যাংকিং প্রযুক্তিকে তাদের নতুন কৌশল হিসেবে দারুণভাবে লুফে নিয়েছেন । সৌদি আরবেই গড়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং এর শত শত অবৈধ কো-এজেন্ট। এর ফলে আগে যেখানে সৌদি আরব থেকে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাংকে লাইনে অপেক্ষা করতে হতো এখন সেখানে প্রবাসীরা কর্মক্ষেত্রে থেকে কয়েক মিনিটের ব্যাবধানেই দেশে টাকা পাঠাতে পারেন। ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে যেখানে তাদের প্রতিটি ট্রানজ্যাকশানের জন্য ২৩ দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৭০ টাকা) খরচ হয়, সেখানে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে তাদের প্রিয়জনদের কাছে দশ হাজার টাকা পাঠাতে মাত্র ১৮০-২০০ বাংলাদেশি টাকা যথেষ্ট। এই কারণে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠানোর পরিবর্তে অবৈধ পন্থায় টাকা পাঠাতে বেশি উৎসাহিত হন।
সরকারি হিসেবে বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় একুশ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। তবে অবৈধভাবে আরো চার-পাঁচ লাখ বাঙ্গালী বর্তমানে এ দেশে অবস্থান করছেন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় আট বছর সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের জন্য সরাসরি ভিসা বন্ধ থাকলেও এই সংখ্যায় খুব বেশী হেরফের ঘটেনি । সৌদি আরবে মূলত বাংলাদেশিদের চুক্তিভুক্ত নিয়মে নির্দিষ্ট কোম্পানি বা মালিকের অধীনে কাজ করার বিধান থাকলেও এই নিয়মের ব্যত্যয়ও আছে অনেক। অনেকেই চুক্তিভুক্ত নিয়মে ভিসা পেলেও তারা সৌদি আরবে গিয়ে স্বাধীন পেশা বেছে নেন। এ ধরণের ভিসাকে বলে ‘ফ্রি ভিসা’। এজন্য ভিসা নেওয়ার সময় তারা যাদের কাছে কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তাদের বছর শেষে মোটা অংকের অর্থ দিতে হয় । সেক্ষেত্রে কাজের অনুমতিপত্র বা ‘ইকামা’র অর্থও তাদের নিজের পকেট থেকে বহন করতে হয়। সৌদি আরবে কাজ করতে গেলে কাজের অনুমতিপত্র বা ইকামা নেওয়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ইকামার জন্য সৌদি আরবের নিয়ম হচ্ছে যেসব কোম্পানিতে ৫০ শতাংশ তার বেশি সৌদি আরবের নাগরিক কর্মরত আছেন সেসব প্রতিষ্ঠানের অন্যদেশের নাগরিকেরা মাসে ৩০০ করে বছরে ৩৬০০ রিয়াল ইকামার জন্য অর্থ দেবেন। আর কোন প্রতিষ্ঠানে ৫০ শতাংশের নীচে সৌদি নাগরিক কর্মরত থাকলে সেক্ষেত্রে ইকামার অর্থের পরিমাণ মাসে ৪০০ করে বছরে মোট ৪৮০০ রিয়াল । এর সাথে ইকামা নবায়নের জন্য ৬৫০ রিয়াল অতিরক্ত চার্জ এবং গড়পড়তা ৬০০/৭০০ রিয়াল ইন্সুরেন্স ফি প্রযোজ্য। যারা সরাসরি কোম্পানিতে কাজ করেন তাদের জন্য ইকামার এই অর্থ কোম্পানি বহন করে। তবে ফ্রি ভিসার শ্রমিকদের এই অর্থ নিজেদের বহন করার পাশাপাশি তাদের চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি/মালিককেও অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয় । সেক্ষেত্রে ছয় হাজার রিয়ালের ইকামার জায়গায় তাদের ১২ হাজার কিংবা কখনো ১৫ হাজার রিয়াল পর্যন্ত অর্থ দিতে হয়। তবে বছরে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ পর্যন্ত বাংলাদেশি সমমূল্য টাকা দিয়েও অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী ফ্রি ভিসায় কাজ করে যাচ্ছেন। এবং এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের উপরে ছাড়াবে।
সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি কৌশল নিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে সেদেশে বিদেশি শ্রমিকদের সংখ্যা বিশ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনবে। সম্প্রতি সে উদ্দ্যেশ্যে ১২ টি পেশার উপর প্রবাসীদের কাজ করার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সৌদি সরকার। সৌদিকরণের এই ধারাবাহিকতায় ১২ রকমের দোকানে কেবল সৌদি নাগরিকরাই কাজ করতে পারবেন। এসব দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের পোশাক তৈরির কাপড়ের দোকান, আওয়ানি মঞ্জিলিয়া বা তৈজসপত্রাদির, গাড়ির যন্ত্রপাতির দোকান, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎ চালিত সামগ্রী, হাসপাতাল সামগ্রী এবং চকলেট বা মিষ্টান্ন জাতীয় পণ্যের দোকান, গাড়ির বিক্রয় কেন্দ্র, বাড়ি বা গৃহ নির্মাণ সামগ্রী, চশমা, ঘড়ি, কার্পেট ও পাপোশ জাতীয় পণ্য এবং আসবাবপত্র বা ডেকোরেশনের দোকান। বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কোন খাতে কতজন কাজ করছেন এই নির্দিষ্ট হিসাব দিতে না পারলেও এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে সৌদি আরবে মোট ২৫ লাখ প্রবাসীর অর্ধেকের কাছাকাছি।
এছাড়া ইকামার অর্থ হারের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে সৌদি সরকার। ২০১৯ সাল থেকে ৫০ শতাংশের বেশি সৌদি নাগরিক কাজ করা কোম্পানির শ্রমিকদের মাসিক ৫০০ রিয়াল এবং ৫০ শতাংশ সৌদি কর্মীর নীচে থাকা কোম্পানির ক্ষেত্রে মাসিক ৬০০ রিয়াল করে ইকামা চার্জ প্রযোজ্য হবে। ২০২০ সালে এই হার হবে যথাক্রমে ৭০০ এবং ৮০০ রিয়াল । মাসিক ৮০০ রিয়াল করে ইকামার জন্য ইন্সুরেন্স সহ এককালীন প্রায় এগারো হাজার রিয়াল বহন করা অনেক ছোট ছোট সৌদি কোম্পানির জন্য প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সত্যিকারে এসব কোম্পানির বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবেনা। ফ্রি ভিসা বহনকারীদের ক্ষেত্রে এই অংক ২০ থেকে ২৫ হাজার রিয়াল (বাংলাদেশি টাকায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার উপরে) পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে। ছয় থেকে দশ লাখ টাকা দিয়ে সৌদি আরবের ফ্রি ভিসা কিনে, বছরে পাঁচ লাখ টাকা ইকামার পিছনে খরচ করা বাংলাদেশিদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
আবার সাম্প্রতিক সময়ে সরকার জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) প্রকল্পের আওতায় অল্প টাকায় মাত্র ৮০০ রিয়াল (১৬ হাজার টাকা) বেতনে মহিলা গৃহকর্মী পাঠানোয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। পাঠানো গৃহকর্মীদের অনেকেরই সৌদি নাগরিকদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছেন । বাংলাদেশ সরকারের সর্বমোট পাঁচ লাখ গৃহকর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও সরকার বর্তমানে নানা কারণে গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে না। এ নিয়ে কূটনৈতিক ভাবেও সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে শীতল সম্পর্ক চলছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
ইকামার অর্থ বৃদ্ধি, ১২ পেশায় প্রবাসীদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা, শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কসহ সব মিলিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ভাগ্য একেবারে অনিশ্চিত। আর সংখাটা নেহাত কম নয়, পঁচিশ লাখের উপরে। তার সাথে জড়িত রয়েছে ২৫ লাখ পরিবারও।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির হিসাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৫ লাখ লোক বেকারত্ব বরণ করে। বিশ্বব্যাংকের মতে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। আর যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্টের মতে দেশের মোট স্নাতকের ৪৭ শতাংশই বেকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনার জন্য প্রসিদ্ধ সৌদি আরবের ২৫ লাখ জনগোষ্ঠী হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে গেলে নিশ্চিতভাবেই সামগ্রিক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। প্রস্তুত আছে কি বাংলাদেশ ?