সবার দৃষ্টি উচ্চ আদালতে

আকন মোঃ বসির
আকন মোঃ বসির, প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৭:২৫ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

আদালত
অনলাইন ডেস্কঃ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি আজ। আবেদনটি উচ্চ আদালতে রোববারের কার্য তালিকায় রাখা হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। খালেদা জিয়ার জামিন হবে কিনা তা জানতে আদালতের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, তারা আশাবাদী এ মামলায় জামিন হবে। দুদকের মামলায় ৫ থেকে ১০ বছরের সাজা হলেও আসামির জামিনের নজির আছে। অন্য কোনো মামলায় যদি নতুন করে গ্রেফতার দেখানো না হয় তবে জামিন পেলে খালেদা জিয়ার কারা মুক্তিতে বাধা নেই বলেও জানান তার আইনজীবীরা। এর আগে দায়ের করা চারটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। দুদকের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করবেন। এরপরও জামিন হলে কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তারা আদেশের বিরোধিতা করে চেম্বার জজ আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন।

খালেদা জিয়ার নামে অন্য কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট আছে কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। এ বিষয়ে উনারা ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু বলব, আইন আইনের গতিতে চলবে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাউকে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে না।

জামিন শুনানির বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্যানেল আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা জামিন শুনানি করব। আশা করছি খালেদা জিয়া জামিন পাবেন। যে মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে এর কোনো ভিত্তি নেই।

সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা শুনেছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অন্য কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাবে না। আমরাও আশা করছি তাই। তিনি বলেন, দুদক যেহেতু সাজা বৃদ্ধির কোনো আবেদন করেনি সেহেতু আমরা আশা করছি খালেদা জিয়ার জামিন হলে তারা (দুদক) আপিলে যাবে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য। সাধারণত যে আসামি পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাদের জামিন দেয়া হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা নেই। এছাড়া তার বয়স ও তিনি অসুস্থ এসব কারণেও তার জামিন হওয়া উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, খালেদা জিয়ার নামে আগের আরও চারটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, তাদের কাছে নতুন কোনো মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর নেই। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা বা শ্যোন অ্যারেস্টের কপি তাদের হাতে পৌঁছায়নি। খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলায় একটা পরোয়ানা পাঠিয়েছেন। দুদকের পিপি মোশাররফ হোসেন কাজলের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত পিডব্লিউ দিয়েছেন। আজ আমরা বিষয়টি কোর্টকে অবহিত করব। তবে এর জন্য ম্যাডামকে কোর্টে যেতে হবে না।’ তিনি বলেন, ‘জামিন পেলে জেল থেকে মুক্তি বিলম্ব করার কৌশল হিসেবে দুদকের পিপি একটা দরখাস্ত আদালতে দিয়েছেন।’

মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার পক্ষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। এর একদিন পর বৃহস্পতিবার তারা খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আলাদাভাবে আবেদন করেন। আদালত এদিন দুটি আবেদন গ্রহণ করে খালেদা জিয়ার অর্থদণ্ড স্থগিত করেন এবং রোববার জামিনের শুনানির দিন ধার্য করেন। এ সময় আদালত বলেন, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। হাইকোর্ট ওইদিনই বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন। আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রেকর্ড (নথি) পাঠানোর জন্য বিশেষ জজ আদালতের বিচারককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সেদিনই (বৃহস্পতিবার) আদালতকে বলেছি, খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন। জরিমানা স্থগিত করেছেন। বিচারিক আদালতের নথিও তলব করেছেন। কিন্তু আমরা ওইদিন (বৃহস্পতিবার) সকালেই নথিপত্র পেয়েছি। নথি পর্যালোচনার পর আমরা শুনানি করব। জামিন আবেদনের শুনানির জন্য এটি কার্যতালিকায় রাখার কথাও বলেছি। তিনি আরও বলেন, আজও (রোববার) আদালতে বলব নথি আসার পর শুনানি হোক।

৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. আক্তারুজ্জামানের আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। একই আদালত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয় আসামির সবাইকে মোট ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এ অর্থ দণ্ডের টাকা প্রত্যেককে সমান অঙ্কে প্রদান করতে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ের পর থেকে ১৮ দিন ধরে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া।

বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার ৩২টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, আবেদনকারীর বয়স ৭৩ বছর। তিনি শারীরিকভাবে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। তিনি ৩০ বছর ধরে গেঁটে বাত, ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, ১০ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে আয়রন ঘাটতিতে ভুগছেন।

আবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৯৭ সালে খালেদা জিয়ার বাঁ হাঁটু এবং ২০০২ সালে ডান হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে তার গিঁটে ব্যথা হয়, যা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। এ কারণে তাকে হাঁটাহাঁটি না করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। শারীরিক এসব জাটিলতার কারণ বিবেচনায় নিয়ে জামিন মঞ্জুরের আর্জি জানানো হয়। অপর যুক্তিতে বলা হয়েছে, উপমহাদেশ ও দেশের উচ্চ আদালতের দীর্ঘ ঐতিহ্য অনুযায়ী, আসামি নারী হলে তার অনুকূলে জামিন বিবেচনা করা হয়। জামিনের আরেক যুক্তিতে বলা হয়, মামলার প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা জামিন আবেদনকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি। তাছাড়া জামিন আবেদনকারী বাংলাদেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন। বিচারিক আদালত এ বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। যে মামলায় তাকে সাজা দেয়া হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাকে হয়রানি করার জন্য।

জামিন পেলে মুক্তি পাবেন কি খালেদা? : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে নতুন কোনো মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পৌঁছেছে কিনা তা জানতেই চাইলে ডিআইজি (প্রিজন) তৌহিদুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমার জানামতে ১২ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় কারাগারে পরোয়ানা এসেছিল। এরপর আর কোনো পরোয়ানা এসেছে কিনা জেলার বলতে পারবেন। ঢাকার জেলার মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার নামে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা কারাগারে আসেনি। তবে শাহবাগ ও তেজগাঁও থানায় দায়ের হওয়া দুটি মামলায় হাজিরার পরোয়ানা এসেছিল। ওই দুটি মামলায় তিনি (খালেদা জিয়া) জামিনে আছেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পাবেন কিনা এমন প্রশ্নে জেলার বলেন, যেহেতু এখন পর্যন্ত তার নামে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জেলে এসে পৌঁছেনি, কাজেই তিনি জামিন পেলে তার কারা মুক্তিতে কোনো বাধা নেই।

গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের অপেক্ষায় আরও ৪ মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রয়োজনে যে কোনো সময় এসব মামলায় কারাগারে থাকা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলে সূত্রটি আভাস দিয়েছে। চারটি মামলার মধ্যে দুটি ঢাকায়, একটি কুমিল্লা ও একটি নড়াইলের। ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু শনিবার যুগান্তরকে বলেন, জন্মদিন পালন এবং মানহানি সংক্রান্ত দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। কুমিল্লার একটি মামলায়ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা করেন। তদন্ত শেষে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থানার ইন্সপেক্টর এবিএম মশিউর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই বছরের ১২ অক্টোবর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার অভিযোগে নড়াইলের আদালতে ইমাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি একটি মানহানি মামলা করেন। নড়াইলের পুলিশ সুপার সরদার রাকিবুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, মানহানির ওই মামলায় খালেদা জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় ৮ জন হত্যা মামলায়ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে জেলা বিএনপির আইনজীবী কাইমুল হক রিংকু যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার নামে কুমিল্লায় কোনো শ্যোন অ্যারেস্ট নেই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা শাখার ইন্সপেক্টর ফিরোজ আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমি আদালতে মামলার চার্জশিট দিয়েছি। এ চারটির মধ্যে যে কোনো একটি মামলায়ও যদি খালেদা জিয়াকে শোন অ্যারেস্ট দেখানো হয় তবে তাকে সেজন্য আলাদাভাবে জামিন নিতে হবে।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)