কাঁটাতারের দুপাশে আনন্দ অশ্রু,দিনব্যাপী মিলনমেলা।
অনলাইন ডেস্কঃ পঞ্চগড়ের চারটি সীমান্তে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের দিনব্যাপী মিলনমেলা। পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ও মাগুরমারী সীমান্তে এবং তেতুলিয়া উপজেলার সুকানি ও ভুতিপুকুর সীমান্তে হাজার হাজার মানুষ মিলিত হন।
প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে এসব সীমান্তে মিলনমেলা হলেও এবার পরের দিন অর্থাৎ আজ রোববার দিনব্যাপী এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রত্যেকটি সীমান্তে ছিল শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী-পুরুষের উপচে পড়া ঢল।
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও,
দিনাজপুর, নীলফামারীসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দর্শনার্থীরা দীর্ঘদিন পর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সকাল থেকে জেলার সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলার চারটি সীমান্ত পয়েন্টের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় জড়ো হতে থাকে কাঁটাতারের উভয় পাশে।
অপরদিকে ভারতের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার জেলা এবং শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ, চোপরাসহ বিভিন্ন এলাকার ভারতীয় নাগরিকরাও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে কাঁটাতারের অপর পাড়ে জড়ো হন।
আজ সকাল ১০টার পরই কাঁটাতারের উভয় পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দুই দেশের লাখ লাখ মানুষ। কাঁটাতারের বেড়ার দুপাশে দুই দেশের নাগরিক হলেও জাতীতে তারা এক। এরা সবাই বাঙালি। একে অন্যের আত্মীয়। দীর্ঘদিন পর কাছের মানুষদের দেখতে পেয়ে তারা ভুলে যান সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ফাঁক গলিয়ে একে অন্যের হাত ধরেন, কথা বলেন। বিনিময় করেন নানান উপহার সামগ্রী। কেউ আবার কেঁদে ফেলেন আবেগে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ)পাহারায় নোম্যান্স ল্যান্ডের কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে উভয় দেশের নাগরিকদের মিলনমেলায় ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছাস। সকাল ১০টা থেকে একযোগে এ মিলনমেলা শুরু হয়। চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর অনেকের আত্মীয়স্বজন উভয় দেশে থেকে যায়। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় অনেকেরই যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। পাসপোর্ট করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভারত বা বাংলাদেশে যাতায়াত করে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দুই দেশের মানুষ এই বিশেষ দিনটিতে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, অমরখানা সীমান্তের মেইন পিলার ৭৪৩ এর তিন সাব পিলার থেকে মেইন পিলার ৭৪৪ এর দুই সাব পিলার, মাগুরমারী সীমান্তের মেইন পিলার ৭৪২ এর ১১ সাব পিলার থেকে মেইন পিলার ৭৪২ এর ১২ সাব পিলার, সুকানি সীমান্তের মেইন পিলার ৭৪১ এর ৬ সাব পিলার থেকে মেইন পিলার ৭৪১ এর সাত সাব পিলার এবং ভুতিপুকুর সীমান্তের মেইন পিলার ৭৩৭ এর দুই সাব পিলার থেকে ছয় সাব পিলার এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মিলনমেলা জমে উঠে।
বিজিবির অমরখানা বিওপির বিপরীতে কুন্দন আর চাউলহাটি বিএসএফ ক্যাম্প, বিজিবির সুকানি বিওপি ক্যাম্পের বিপরীতে বিএসএফের মদনবাড়ি ক্যাম্প, বিজিবির ভুতিপুকুর বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীতে বিএসএফের গাটরা ক্যাম্প, বিজিবির মাগুরমারী বিওপির বিপরীতে বিএসএফের চাউলহাটি ও ভোলাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা এই মিলনমেলায় উভয় পাশে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে বাংলাদেশ ও ভারতের হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা স্বাক্ষাৎ করছেন। আপন জনদের খুঁজে বের করার জন্য সীমাহীন উৎকণ্ঠা কাজ করছিল সবার মাঝে। স্পর্শ দিয়ে আপনজনদের কাছে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও প্রতিবন্ধকতা ছিল কাঁটাতারের বেড়া।
তবুও হাত দিয়ে ছুয়ে দেওয়া, দুচোখের দৃষ্টি দিয়ে একে অপরকে একনজর দেখা, কুশল বিনিময়, দীর্ঘদিন পর মিলনের আনন্দে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। দুই দেশের নাগরিকরা মিলনমেলায় একে অপরকে নানান সামগ্রী বিতরণ করেন। কাঁটাতারের ওপর দিয়ে বিস্কুট চানাচুর, পানীয়, শাড়ি-লুঙ্গি, সাবান, সিগারেটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেন একে অপরকে।
এ ছাড়াও এবার ইলিশ মাছ, আপেল-কমলা, জুসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও দেওয়া-নেওয়া করা হয়। কেউ কেউ বেড়ার এপার-ওপার হাত নাড়িয়ে এবং উচ্চ স্বরে কথা বলে স্বজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। মা-মেয়েকে, বাবা-ছেলেকে, ভাই-বোনকে দেখতে পেয়ে দুচোখ বেয়ে চোখের জল ফেলেছেন। তবে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন নি।
সীমান্ত এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন, আজ ভোর থেকেই দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা এসে জড়ো হন ওই সীমান্তে। দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষেরা এক অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চানননি কেউ।
ভারতের মাটিগাড়ায় থাকা ভাই নিজেন্দ্রনাথ (৬০) ও ভুষেন্দ্রনাথ (৩৫) এর সঙ্গে দেখা করতে আসা পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বোয়ালমারীর রাজেন্দ্রনাথ (৫৫) জানান, প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে ওপার বাংলায় থাকা ভাইাদের সাক্ষাৎ করি, তাদের খোঁজ-খবর নিই। জলপাইগুড়ির কালিবাড়ী পান্ডাপারায় থাকেন বাচ্চাবালা নামে অপর এক বোন। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
বোদা উপজেলার কাদেরপুর ময়দানদিঘী থেকে আসা ৯০ বছরের প্রসন্ন কুমার ভারতের চোপড়া পথানার দাসপাড়ায় থাকা বোন সনেকার (৪০) দেখা করেছেন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চন্ডিপুর থেকে আসেন হরমোহন (৬০)।
শিলিগুড়ির জলডুম ফাড়াবাড়ি এলাকায় বসবাস করেন ভাই প্রহল্লাদ বর্মন (৭০)। ৪০ বছর পর তাদের এবারই প্রথম দেখা হলো। দুজনেই কেঁদেছেন, খুশিও হয়েছেন। জড়িয়ে ধরতে পারেননি এটুকুই কষ্ট। তাদের মতে, এখানে সীমান্ত হাট স্থাপন করা উচিত, তাহলে কেনাকাটার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনরা এসে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবেন।
পঞ্চগড় শহরের আব্বাস আলী বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আমার অনেক আত্মীয় আছে। মিলনমেলায় জলপাইগুড়ির ভেলাকোপায় থাকা মামা মোশাররফ হোসেন, শিলিগুড়ির ফুলবাড়ির ভায়রা মোজাফ্ফর হোসেন, জলপাইগুড়িতে থাকা সমন্ধি ময়নুল ও শ্যালিকা লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথাও হলো। ’
তেতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মোকসেদ আলী ও অমরখানা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান নুরু জানান, ভিসা-পাসপোর্ট না থাকা দরিদ্র পরিবারের লোকজন বছরের এ দিনটিতে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্যই অপেক্ষায় থাকেন। পৃথক দুটি দেশে বসবাস করলেও হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর নারীর টানে বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, চাচা-চাচী, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সান্নিধ্য আর মনের মাঝে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অব্যক্ত ভাবভাষা বিনিময় করেন।
নীলফামারী-৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী আবুল কালাম আজাদ জানান, নীলফামারী ও পঞ্চগড় বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীনে পঞ্চগড় সদর ও তেতুলিয়া উপজেলার অমরখানা, ভুতিপুকুরী, সুকানী ও মাগুড়মারী সীমান্তে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এই মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের মিলনমেলায় বিজিবির ঠাকুরগাঁও সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ শামছুল আরেফীনসহ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী জেলার বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন
এ এম বি। পি এন