ফেলে দেওয়া শিকড়-বাকড়ে নান্দনিক যত শিল্পকর্ম
গাছের ফেলে দেওয়া শেকড়-বাকড় দিয়েই বানানো হয়েছে মাশরাফিকে। সেখানে নানা ভঙ্গিমায় বোলিং করছেন তিনি। ঠাকুরমার সামনে বসে গল্প আসরে নাতি-নাতনি, মায়ের সামনে বসে নিশ্চিন্তে খেলতে থাকা শিশু, দাঁড়ানো ঘোড়া, পানিতে কুমির, উড়তে উদ্যত পাখি; আছে আরও অনেক কিছু; কিন্তু সবকিছু শেকড়-বাকড়ে তৈরি। গাছের ওপর হাতুড়ি ও বাটাল দিয়ে অনুপম এ সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন সমীরণ দত্ত। ফেলে দেওয়া শেকড়-বাকড়ে নানা ধরনের এই শিল্পকর্ম করছেন তিনি ১৮ বছর ধরে। দেশ ছাড়িয়ে তার কাজ যাচ্ছে এখন বিদেশেও।
শিল্পী সমীরণ দত্ত বলেন, ‘কাগজে-কলমে আমি ডিগ্রি নিয়েছি অ্যাকাউন্টিং থেকে; কিন্তু নিজেকে সঁপে দিয়েছি সৃষ্টিশীল কাজে। শেকড়-বাকড় দিয়ে সাজাই কল্পনার বাগান। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো শুরু করা প্রদর্শনীর নাম দিয়েছিলাম তাই- মন বাগানের পাখি। এর আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও আটটির প্রদর্শনী করেছি। সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি এবার। দিন যত যাচ্ছে ততই জনপ্রিয় হচ্ছে ফেলনা জিনিস দিয়ে তৈরি হওয়া নানান শিল্পকর্ম।’
ছোটবেলা থেকেই সৃষ্টিশীল কাজে ব্যাপক আগ্রহ পেতেন সমীরণ। ধান দিয়ে আঁকতেন ছবি, আবার ডাল দিয়ে বানাতেন ওয়ালম্যাট। মনের ভালো লাগা থেকে করা এসব কাজই তাকে টেনে এনেছে কাঠশিল্পে। চট্টগ্রামের প্রদর্শনীতে ভাস্কর্য ও ফার্নিচারের ১৪৫টি আইটেম তুলেছেন তিনি। এগুলোর কোনোটি ১৮ বছরের পুরনো, কোনোটির বয়স ১৮ দিন। কাঠ দিয়ে কুমির, হাঁস, ডাইনোসর ও পাখির ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, গাছের শেকড়-বাকড় দিয়ে বানিয়েছেন আস্ত ডাইনিং টেবিল, চেয়ার কিংবা টেবিলও। পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত দাম এসবের। আছে পৌনে দুই লাখ টাকার ফার্নিচার সেটও।
১৮ বছরে পাঁচ হাজারেরও অধিক শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন সমীরণ দত্ত। প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে শিল্পী জানান, ভাস্কর্য মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। এটি দেখে সুখ পায় মানুষ; কিন্তু ভাস্কর্যের ক্রেতা কম। ফার্নিচারের ক্রেতা বেশি। শেকড়-বাকড় দিয়ে তৈরি হলেও এসব ফার্নিচার সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই। দেখতে ব্যতিক্রম হওয়ায় এ শিল্পকর্ম নজরও কাড়ে দর্শনার্থীদের। আকারে ছোট হওয়ায় এ শিল্পকর্মে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে হয় হাতুড়ি ও বাটাল। ইলেকট্রিক কিছু কাটার মেশিন ব্যবহার হলেও সেটি শিল্পকর্ম শুরুর প্রথম দিকে সীমিত আকারে ব্যবহার হয়। মূল কাজটা ফুটিয়ে তুলতে হয় হাতুড়ি দিয়ে।
ফেনী সোনাগাজী উপজেলার গোয়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও সমীরণ দত্তের ঠিকানা এখন চাঁদপুর শাহরাস্তি এলাকার ঘুঘুশাল গ্রাম। এ গ্রামেও একটি কাঠকর্মের প্রদর্শনী করেছেন তিনি। প্রতিটি শিল্পকর্মের একটি প্রতীকী নাম রেখেছেন তিনি। শেকড় দিয়ে তৈরি করেছেন উড়তে উদ্যত ডানা মেলা এক পাখি। এটির নাম দিয়েছেন- কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। নাগরিক প্রতিযোগিতাকেও কাঠকর্মে তুলে ধরেছেন তিনি। এতে দেখা যায় কেউ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উপরে উঠছে। আবার কেউ সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পতিত হচ্ছেন নিচে। কোনো কোনো শিল্পকর্ম করতে কেটে যায় মাসের পর মাস। আবার কোনোটি ছোঁয় বছরের ঘর। সর্বশেষ কাঠ প্রদর্শনীটি করতে প্রায় চার বছর দুই মাস সময় নিতে হয়েছে তাকে। অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াশোনা করলেও শিল্পীর মনোজগতে পরিবর্তন এনে দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনসুরুল করিম। ১৮ বছর আগে তার প্রথম করা কাজ দেখে ভুয়সী প্রশংসা করেছেন চারুকলার এ শিক্ষক। কাজ শুরুর পাঁচ-ছয় বছর পর গভীর মনোযোগে দেখেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কাজ। স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধুদের কাছ থেকেও পেতে থাকেন উৎসাহ। এ কারণে শেকড়-বাকড় নিয়ে কাজ করার আগ্রহ ক্রমেই বাড়তে থাকে তার। ২ ডিসেম্বর পঞ্চাশে পা রাখছেন সমীরণ দত্ত। তবে সৃষ্টিশীল এ কাজ করে যেতে চান অন্তত শত বছর।