গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বনাম মুক্তমতের স্বাধীনতা
শফিকুল ইসলাম খোকন
আমরা জানি দেশের যেকোনো আইন সার্বজনীন, কোনো ব্যক্তি বা মহলের জন্য আইন তৈরি হয় না। সব আইনই হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। কেউ দুর্নীতি, অন্যায় করলে ওই আইনের আওতায় আসবে। সে মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, এনজিওকর্মী, সাংবাদিক কিংবা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। কেউ আইনের ব্যতয় ঘটালে শাস্ত্মির আওতায় আসে বা আসতে বাধ্য। আমরা প্রতিটি নাগরিকই অন্যায়-অপরাধ করতে চাই না ওই সব কাজে জড়াতেও চাই না। আমরা দেশের সব আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ সব সময়ই থাকে বা করতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা নিয়ে সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা বয়ে গেছে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ বহুল আলোচিত কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্ত্মির বিধান পুনর্বিন্যাস করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্ত্মির বিষয় উলেস্নখ রয়েছে। ৩২ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সব মহলে।
আগেই বলেছি, দেশের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাবোধ আমার রয়েছে, তেমনি দেশের সব আইনের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকারও আমার রয়েছে। সমালোচনার খাতিরে একটু বললেই নয় এটি হচ্ছে- আমার নিজ এলাকার সৌদি প্রবাসী মো. মাহমুদ নামে এক যুবক চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ওই স্ট্যাটাসে অশস্নীল এবং অপমানজনক লেখা লিখলেও তার বিরম্নদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এমন স্ট্যাটাস নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ সম্মেলনসহ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও মামলা কিংবা সুয়োমুটো রম্নল করতে দেখা যায়নি। বরং মামলা না করে অপমানের বিচার হলো মাত্র ১০টি জুতার পিটান! অথচ সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরম্নদ্ধে হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। আনিস আলমগীর লিখেছিলেন- হিন্দু ধর্ম নিয়ে আর মাহমুদ নামে ওই প্রবাসী যুবক লিখেছিলেন যাদের অক্লান্ত্ম পরিশ্রম এবং জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে আর সেই স্বাধীন দেশে আমরা বাস করছি, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি। দুজনের অপরাধ একই রকম। দুজনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে। একটি বাস্ত্মব উদাহরণে কি মনে হয়, আইনে বৈষম্য নাকি অপরাধী ব্যক্তি বিশেষ বৈষম্য? তাহলে আমরা কি বুঝব, অপরাধের শাস্ত্মি নাকি অপরাধীর শাস্ত্মি।
আমার এক সহকর্মী সাংবাদিক ৫৭ বা ৩২ ধারাসহ সাংবাদিকতা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা জানি একটি পুকুরে মানুষ পড়লেই মারা যাবে অথবা পরে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে, তাহলে মারা যাওয়া থেকে বিরত থাকতে ওই পুকুরের চারপাশে ঘুড়াঘুড়ি করার কি দরকার? ওই ধারাগুলোতে যে ব্যাখ্যা রয়েছে ওই সব কাজ না করলেই তো হয়?’ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকদের কাজ কি? সংবাদ সংগ্রহ করা, সংবাদ পরিবেশন করা, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা। আইনের ব্যাখ্যায় যা রয়েছে সেটিতে পুরোপুরি ফলো করে বা করতে হয় সাংবাদিকদের। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ভুয়া আইডিও ব্যবহার করে সম্মানহানিরও স্ট্যাটাস বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তার দিকে তাকিয়ে মূল লক্ষ্যভ্রষ্ট সমীচীন নয়। অথচ এসব আইডিতে মানহানিকর স্ট্যাটাসের কারণে চিহ্নিতও হয়নি বা বন্ধ না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে মুক্ত সাংবাদিকদের সাংবাদিকতাকে পেঁচিয়ে গলা কাটা নয় কি? প্রশ্ন হচ্ছে, আইন যদি সার্বজনীনই হয় এবং ৫৭ বা ৩২ ধারা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এটি লিখলে বা প্রকাশ করলে অপরাধ হয়, তাহলে কেন বিগত বছরগুলোতে শুধু ৫৭ ধারার আওতায় সাংবাদিকরা আসবে, কেনই বা ৫৭ ধারায় শুধুমাত্র সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে মামলা হবে? এই অপরাধে কজন বস্নগার, সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের বিরম্নদ্ধে মামলা হয়েছে? ওই ধারায় তো সাংবাদিক শব্দটি উলেস্নখ নেই? তাহলে কেন সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে এত মামলা? কথায় বলেনা- অপরাধ নির্মূলের চেয়ে অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সেগুলো সংগঠিত না করা। কিন্তু আমরা সব সময়ই অপরাধ ঘটার পরেই সব কিছু নিয়ে ভাবি, ঘটার আগে নয়; সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইবু্যনালের প্রসিকিউটরের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত্ম সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া ৭৪০টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা রয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হওয়ার পর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারাদেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২-তে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত্ম এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে। যা নিয়ে বিগত দিনে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ একটি কথার সঙ্গে আমিও একমত। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিয়ে বলেছেন- ‘এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরম্নদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’ (সূত্র : বাংলাট্রিবিউন, তারিখ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭)। শুধু জনপ্রতিনিধি কেন একজন সুইপারেরও মান-সম্মান রয়েছে। তার এ কথা থেকেই মনে হয়েছে কিনা এমপিদের মান-সম্মান রয়েছে, আর কেউর নেই। সাংবাদিকরা শুধু এমপিদের নিয়েই সংবাদ প্রকাশ করে থাকেন, আর কাউকে নিয়ে কিছুই লেখেন না। তার বক্তব্যে মনে হচ্ছে না, এ আইন শুধুমাত্র সাংবাদিকদের গণমাধ্যমে মত প্রকাশের বিরম্নদ্ধে। সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ বা কণ্ঠ রোধ যাই বলিনা কেন- প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এবং এর ১১ (বি) ধারা অনুযায়ী প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ সাল সংশোধিত) থাকার পর আর কোনো নতুন করে আইনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে যেহেতু দেশসহ বিশ্বজুড়েই তথ্যপ্রযুক্তিতে সয়লাব সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রস্ত্মাবিত ওই আইনে সার্বজনীনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী একটি ধারা থাকতে পারত। সেটি হওয়া উচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে। আইনে সাংবাদিকদের কাজকে আলাদাভাবে সন্নিবেশিত না থাকার কারণেই তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারা সাংবাদিকদের বেলায় অপব্যহার করা হয়েছিল। প্রস্ত্মাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বেশ কয়টি ধারাও ঠিক ৫৭ ধারারই অনুসরণ করবে এবং সাংবাদিকরা হয়রানি হবে।
ধারা নিয়ে আমার কোনো মতবিরোধ নেই। আমি বরাবরই ৫৭ ধারা কেন সব আইনের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল এবং পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু ধারার ব্যাখ্যার বিষয়ে আমার আপত্তি রয়েছে। ইতোপূর্বে ৫৭ ধারায় যত মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগই সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে। এ কারণেই এত সমালোচনা।
বিগত দিনের সমালোচনার আলোকে আমার মনে হয়েছে- ‘৫৭ ধারাটি মনে হয় শুধুই সাংবাদিকদের জন্য; আসলে ৫৭ ধারা কি সাংবাদিকদের জন্য? ওই ধারায় কি বলা আছে- ৫৭ (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশস্নীল বা সংশিস্নষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরম্নদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ (২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি ৫ অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অনূ্যন সাত বৎসর কারাদ-ে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ-ে দ-িত হইবেন।’?
আর প্রস্ত্মাবিত আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে গোপনে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ফেসবুকে এ নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাসে অনেকেই লিখেছেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। নতুন মোড়কে পুরানো পণ্য, অথবা বোতলটা নতুন, তবে মদটা পুরোনো নয় ইত্যাদি।
সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের আপত্তির মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন বাতিল নিঃসন্দেহে সরকারের শুভবুদ্ধিরই পরিচায়ক। তবে মন্ত্রিসভায় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন করা হয়েছে তাতে ঘুরে-ফিরে ৫৭ ধারা বহাল রাখা হয়েছে কিনা সেটি বড় মাপের একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে স্বাধীন সাংবাদিকতাও এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা মোটেও কাম্য হবে না, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত্ম করে কিংবা মানুষের বাক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। আমরা মনে করি, সংসদে পাস হওয়ার আগে আইনটি আবার বিবেচনা করা হবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
শফিকুল ইসলাম খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
ইমেইলঃ msi.khokonp@gmail.com