ছোট্ট আশরাফুলের বাংলাদেশ ক্রিকেটে উঠে আসার গল্প
একট মজার বাস্তব গল্পঃ সময়টা ১৯৯৩ সাল। এক শীতের দিনে সিদ্ধেশ্বরী ক্রিকেট মাঠে দুটো প্র্যাকটিস সেশন চলছিল নেটে। সিদ্ধেশ্বরী ক্রিকেট মাঠ বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই এক ঝাঁক গৌরবের সাক্ষী, যে মাঠ তুলে এনেছিল ক্রিকেটেরই কিছু ধ্রুবতারা। সেদিন খালেদ মাহমুদ সুজন এবং ইমরান হামিদ পার্থ কঠোর অনুশীলন করছিলেন নেটে, কারণ সামনেই অমরজ্যোতি ক্লাবের হয়ে খেলতে নামতে হবে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে। মোহাম্মদ রফিকও সেদিন হাজির ছিলেন নেটে সবার সাথে, গতবছরই অমরজ্যোতি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। তখনকার সময়ে ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয় ছিলনা। অধিকাংশ মানুষ খেলার নিয়মই জানতো না। তখনো বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি খেলতো, কিন্তু সেটাও অনেকটা অংশগ্রহন করার জন্যই।
সেই সিদ্ধেশ্বরী মাঠের নেট প্র্যাকটিসের এক নেট বয় ছিল যে কিনা প্রতিদিন চলে আসতো ঠিক সময়ে। গায়ে ক্রিকেটীয় সাদা পোশাক,আর পাতলা শরীরে ক্রিকেটের জন্য তুমুল আগ্রহ। সে বল কুড়োতেই সন্তুষ্ট থাকতো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। সিজন শেষ হতেই সিদ্ধেশ্বরী মাঠের ট্রেনিং সেশন বন্ধ হয়ে গেল। পরে আর সে বছর সিদ্ধেশ্বরী মাঠের আশেপাশেও ছেলেটাকে দেখা গেল না
সাল ১৯৯৪। সিদ্ধেশ্বরী ক্রিকেট মাঠের নেট প্র্যাকটিস আবার শুরু। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্র্যাকটিস শুরু হবে। তখনই ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি আবার ফিরে আসলো। সেই একই সাদা পোশাকে। সবাই হতবাক ছেলেটি যে আবার আসলো। যেন কোন ধর্মীয় রিচুয়াল পালন করতে এসেছে, সময় মেনে। একদিন অমরজ্যোতি ক্লাবের অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি ক্রিকেটার হতে চাও?” ছেলেটি যেন এ প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল। সাথেসাথে বলে উঠলো- “হ্যাঁ, আমি কিছুটা লেগস্পিন করতে পারি।আপনি চাইলে করে দেখাতে পারি।” সুজন রীতিমত স্তম্ভিত। এই ৯-১০ বছরের ছেলেটা তাকে বল করতে চায়।
ইমরান হামিদ পার্থের নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। আবাহানি ক্লাব এবং বাংলাদেশ এ-দলেও খেলেছিলেন। তৎকালীন সময়ে অবশ্য ছিলেন অমরজ্যোতি ক্লাবের ড্যাশিং বাহাতি ওপেনার। যিনি ছিলেন স্পিনারদের জন্য রীতিমতো ত্রাশ। সেদিন নেটে প্রথম ব্যাট করতে আসে সেই হামিদ। সুজন সুযোগ দিলেন ছোট্ট ছেলেটাকে বল করার। জগতের সব মনোযোগ তখন বলটার দিকে। যে ছোট্ট মাঠে সেই বলটাকে হারানোর কথা ভাবছিল সবাই, সে বলটাই টার্ন এবং বাউন্স করলো। ব্যাটসম্যান হামিদ বিপর্যস্ত তার বলে। মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন ইমরান হামিদ। পরের বলেও একই ঘটনা। ছেলেটি পর পর বল করে গেল। একের পর এক ব্যাটসম্যান আসলো ব্যাট করতে। সবাই বিদ্ধস্ত তার লেগস্পিন জাদুতে। প্র্যাকটিস সেশন শেষে সবার সামনে গিয়ে হাসি দিয়ে সুজনকে ছেলেটা বললো, “দেখলেন? আমি কিছুটা লেগস্পিন পারি।” সবাই অভিভূত। ছেলেটার অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো, যে স্বপ্ন দেখতো একদিন সে ও হয়তো এই নেটে প্র্যাকটিস করবে।
হঠাৎ করেই ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার প্রতি আগ্রহী হয়ে যায়। পরের দিন সকালে ছেলেটা। আসতেই তাকে নিয়ে চলে যায় বিসিবি অফিসে। সাইন করিয়ে নেয় অমরজ্যোতি ক্লাবে। তখন তার জন্য জার্সি কেনে ক্লাব। কিন্তু ছোট্ট শরীরে সেটা ফিট করতে বেশ বেগই পেতে হয়েছিল দর্জিকে। পরের ৭দিন সে যতখুশি ইচ্ছে বল করেছিল। ক্লাবের প্লেয়াররা জেনে গিয়েছিল তারা পেয়ে গেছেন এক ম্যাচ উইনারকে। ৮ম দিনে পান প্রথম ব্যাট করার সুযোগ, শুরু হয় নতুন গল্পের।
পরের দিন ছেলেটি প্রথম ক্লাবের হয়ে খেলতে নামবে। নেটের চারদিকে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটায় সে। ক্রিকেট ম্যানুয়েলের প্রায় সব শটই খেলেছিলেন সেদিন। অবহেলিত ক্রিকেটের দিকে তাকিয়ে হয়তো সেদিন বিধাতা হাসছিলেন আর বলছিলেন, অপেক্ষা কর সে আসছে।
তখন খালেদ মাহমুদ সুজন ক্লাবের কাপ্তান। তিনি এগিয়ে আসেন- ‘তুমি তো দারুণ ব্যাট করো, এক্সচেপশনাল।’ “আমি আসলে বোলারই, যে কিছুটা ব্যাটিং করতে পারে।”-ছেলেটির সরল স্বীকারোক্তি।
খেলার দিন। অমরজ্যোতি ক্লাব বোলিং করতে নামে। সুজন তখন এক ছোট্ট বালককে বোলিং করতে আনেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আম্পায়ার জিজ্ঞেস করেন তার কি নাম? “আশরাফুল, মোহাম্মদ আশরাফুল। “-ছিল উত্তর
১১ এপ্রিল ,২০০১ সাল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের বরপুত্র মোহাম্মদ আশরাফুলের। এক যুগের বর্ণময় ক্যারিয়ারে যিনি অসংখ্যবার হয়েছেন বাঙালিদের উল্লাসের কারণ। হাসিয়েছেন হাজারো বাঙালিকে।
৭ সেপ্টেম্বর ২০০১ শ্রীলংকার কলোম্বতে রচিত হল এক নতুন ইতিহাস। সেই সময়কার আতঙ্ক মুরালি’র মত বোলার দের নাকানি-চুবানি খাইয়ে তুলে নেন সেঞ্চুরি। অভিষেকেই টেস্ট ক্রিকেটের সর্ব কনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে নিজের নাম সোনালী হরফে লেখান ইতিহাসের পাতায়। টেস্ট ক্রিকেটের ১৩০ বছরের ইতিহাসে যেই কৃতিত্ত্ব আজও ভাঙতে পারে নি কেউ। অভিষেকেই নিজের জাত চেনানো আশরাফুল। আস্তে আস্তে বাংলাদেশের একমাত্র খুঁটিতে পরিণত হন।
তার ব্যাটে স্বপ্ন দেখতে থাকে বাংলাদেশ। শ্রীলংকার বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর, ভারতের বিপক্ষে খেলেন সেই মহাকাব্যিক ১৫৮ রানের ইনিংস। সেই ইনিংসটি বাঙালিরা মনে রাখবে যুগ যুগ ধরে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন ও চুনোপুটি। অজি বধের সেই রূপকথা তখনো রচিত হয় নি।
২০০৫ সালে এই আশরাফুলের হাত ধরেই রূপকথার সেই কার্ডিফ কাব্য রচিত হয়। স্বপ্নের সেই জয়ে প্রধান নায়ক এই আশরাফুল। ১০০ বলে ১০০ রানের সেই ইনিংস দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেটে বাঘের গর্জনের শুরু। স্কুপ, ড্রাইভ, পুল শর্ট এ ভরা সেই মহাকাব্যিক ইনিংস। হয়ত সেটা এখনো আশরাফুলের জীবনের সেরা ইনিংস। ঠিক তার পরের ম্যাচে দেখা যায় আরো বিদ্ধংসী এক আশরাফুলকে। ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংস খেলার পথে ছিন্ন ভিন্ন করে দেন ইংরেজ বোলারদের।
শুধু অজিদের বধ করেই থেমে থাকেননি তিনি। একে একে ভারত, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও সাউথ আফ্রিকার মতো পরাক্রমশালী দল কে নাস্তানাবুদ করেছেন তিনি একই। যতগুলো দলের সাথে বাংলাদেশ প্রথম জয় পায়, তার প্রতিটি খেলায় ছিল আশরাফুলের নান্দনিক ইনিংস। তখন সাকিব ছিল না, তামিম ছিল না, ছিল না মুশফিক বা রিয়াদরা। তখন বাংলাদেশ দল কে একাই টেনে নেন এই আশরাফুল।
তার ব্যাট এর দিকে তাকিয়ে থাকত পুরো বাঙালি জাতি। আশরাফুলের ব্যাট হাসলে, হাসত বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও পারে, এই মানসিকতার বীজ বপন করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের বরপুত্র মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০৮ সালে ভারতীয় নিষদ্ধ লীগ আইসিএল এর থাবায় ধ্বংস হয়ে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের নক্ষত্র।
হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে আফতাব, নাফিস কাপালিরা টাকার কাছে নিজেদের মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দেন। জাতীয় দলকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এক এক করে দল ছাড়েন ১৩ জন ক্রিকেটার।
বল হাতে মাঝে মাঝে চমক দেখিয়েছেন আশরাফুল
দলের সেই চরম বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান আশরাফুল। পরম মমতায় আগলে রাখেন বাংলাদেশর ক্রিকেটকে। এক যুগের এই ক্যারিয়াররে বহু উত্থান পতনের সাক্ষী হয়েছেন তিনি। অফফর্মের দোহাই দিয়ে যতবার তাকে জাতীয় দল থেকে ছেড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, ততবার তিনি ঘরোয়া লিগে কাঁপিয়ে জাতীয় দলে প্রবেশ করেছেন।
বার বার তিনি প্রমাণ করেছেন “ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট” তারপর হঠাৎই তার বর্ণময় ক্যারিয়ারে নেমে এলো মেঘের ছায়া।
ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে, ক্রিকেটের কুলীন সমাজ থেকে বিতাড়িত হলেন তিনি।
৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন বাংলার ক্রিকেটের বরপুত্র। একটা মানুষ নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কতোটা পরিশ্রম করতে হয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মোহাম্মদ আশরাফুল।
আশরাফুল মানেই আশায় বুক বেঁধে রাখা। চলতি লিগে ব্যাটের উপর ভর করে রীতিমত উড়ছে আশরাফুল। ডিপিএলে বোলারদের উপর এক প্রকার রোলার চালিয়ে শাসন করেই যাচ্ছেন আশরাফুল। সর্বশেষ তিন ম্যাচে তিনটাই সেঞ্চুরি। ডিপিএলে এক সিজনে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক ও এখন তিনি। এই পারফরম্যান্স এর পুরুস্কার ও পাচ্ছেন হাতে নাতে। সেটা হল তিনিই এখন লিগের টপ স্কোরার। বুজাই যাচ্ছে কতটা ফর্মের তুঙ্গে আছে তিনি ।
কলম্বোতে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করার পর
চলতি লিগে আশরাফুলের পারফরম্যান্স :-১৩ ম্যাচে ৬৬.৫০ গড়ে ৬৬৫ রান। যেখানে রয়েছে পাঁচটি শতক ও ১টি ফিফটি।
অনেকেই আশরাফুলের গড় নিয়ে প্রশ্ন তুলে। গড় ২৪ প্লাস । ছোট একটা উদাহরণ দেই- ৭/৮ বছর আগে যার বেতন ২০০০০ টাকা ছিল, তিনি কিন্তু অনায়াসেই নিজের সংসার চালিয়ে নিতে পারতেন। ৭/৮ বছর পর তো তিনি ২০,০০০ টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়ায় শোধ করতে পারবেন না। সংসার চালানো তো অনেক পরের ব্যাপার। তার সময়ে কয়জন খেলোয়াড়ের গড় ২৫+ ছিল? হাবিবুল বাশারের গড় ছিল ২১+। খালেদ মাসুদ পাইলট এর গড় ছিল ২১+। জাভেদ ওমরের গড় ছিল ২৩+।
তারপরও কিনা আশরাফুলকে শুনতে হয় গড়ের খোটা। …..হাস্যকর নয় ব্যাপারটা?
ওয়ান ডাউন পজিশনে এই পাচ বছরে তো অনেক খেলোয়াড়কে ট্রাই করানো হলো। সাব্বির, এনামুল, লিটন ও ইমরুল……কেউ তো থিতু হতে পারল না। ওদের কারো গড় ৩০+ না।
তাহলে ওরা জাতীয় দলে সুজোগ পেলে আশরাফুল পাবে না কেন!
আশরাফুলরা যে বছর বছর জন্মায় না….হাজার বছরে একজন আসে …..
ধরণী দ্বিধা হও, মুখ লুকাই…. :”)
বিঃ দ্রুঃ উত্থানের গল্পটা আশরাফুলের কাছ থেকে শোনা। এ এম বি / পাথরঘাটা নিউজ
সবাইকে জানাতে শেয়ার কবেন !