রিন্টুকে মনে পড়ে, নাদিরা সুলতানা এমপি
১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। বাংলার আকাশ, বাতাস, প্রকৃতির অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন; যেদিন ক্ষমতালোলুপ বিপদগামী সেনাসদস্যদের হাতে নজির বিহীনভাবে স্বপরিবারে প্রান দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পঁচাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের রক্তের সাথে একাকার হয়েছিল আমার সেজ ভাই আব্দুর নঈম খান রিন্টুও। গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি সেই কালরাতে শহীদ হওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতাসহ তার পরিবারের সকলকে। সেই সাথে পরম স্নেহাহাতীত সন্তানতুল্য ভাই আব্দুর নঈম খান রিন্টুকে।
আমাদের ছয় ভাই-বোনের মধ্যে রিন্টু ছিল চতুর্থ। আমার সাথে ওর বয়সের ব্যবধান ছিল। বড় বোন হলেও আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মা-সন্তানের অকৃত্রিম ভালবাসা ও স্নেহের। ওর চাওয়া-পাওয়া ও আবদারের ভরসা ছিলাম আমি। মায়ের মতোই চেষ্টা করতাম রিন্টুর সকল আবদার পূরণ করতে। সেই সন্তানতুল্য রিন্টুকে স্মরণ করছি গভীর ভালবাসায়। রিন্টুর জন্য আমাকে শোকগাথা লিখতে হবে, রিন্টু আমার আগে মারা যাবে এমনটা আমি ঘুর্নাক্ষরেও ভাবিনি। ওর মৃত্যু আমার কাছে ছিল পর্বতের চেয়েও ভারী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র বর্তমান বরিশাল-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও মন্ত্রী জনাব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ্ ভাই এর সাথে ছিল আমাদের ঘনিষ্টতা।
শৈশব থেকেই রিন্টুর গিটারের প্রতি ছিল আবেগ। ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও গানবাজনার প্রতি ছিল ওর আগ্রহ। নবম শ্রেনিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় রিন্টু আমার কাছে বায়না ধরেছিল ১টা গিটার কিনে দেওয়ার জন্য। পড়াশুনার ক্ষতির কথা ভেবে ঐ সময় না কিনে দিয়ে ওর এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমি একটা গিটার কিনে দিয়েছিলাম।
রিন্টু সব সময় বন্ধুদের সাথে আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় গিটার বাজিয়ে গানের চর্চা করতো। পরবর্তীকালে বন্ধুরা মিলে আরো কিছু বাদ্যযন্ত্র কিনে একটি গানের ব্যান্ড দল গঠন করেছিল। যার নাম দিয়েছিল “ক্রিডেন্স”। এসএসসি পরীক্ষার পর বন্ধুদের সাথে রিন্টু ঐ ব্যান্ড দল নিয়েই সময় কাটাতো এবং ওরা বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করতো।
আনুমানিক ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বরিশালের শিল্পকলা একাডেমিতে ওরা একটি প্রোগ্রাম করেছিল, সেই প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন হাসানাত ভাই। প্রোগ্রামে রিন্টুদের পারফম্যান্স দেখে তিনি মুগ্ধ হন। ব্যান্ড দল নিয়ে ওদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখে ব্যান্ড দলটিকে আরো পরিচিতি দেওয়ার জন্য ওদেরকে ঢাকায় যেতে বলেন। হাসানাত ভাই ওদের বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে কথা দেন।
১২ই আগস্ট ওরা ঢাকায় আসে এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টু রোডের সরকারী বাসায় ওঠে (বর্তমান ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়)। হাসানাত ভাই ১৩ই আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মকর্তাদের সাথে রিন্টুদের ব্যান্ডদল এর পারফম্যান্স ও প্রোগ্রামের ব্যাপারে কথা বলেন।
১৪ই আগস্ট বর্তমান রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ভাইয়ের পিতা তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামানের বাসায় হাসানাত ভাই ওদের নিয়ে প্রোগ্রাম করতে যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে রিন্টু ও ওর বন্ধুরা বরিশালে রওয়ানা হলে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত লোক পাঠিয়ে ওদের আরো আতিথেয়তার জন্য বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং ১৪ই আগষ্ট দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ই আগষ্ট কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির পরিবার। রিন্টুও সেই দিন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সাথে নিহত হয়। ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে ঝাঝরা হয়ে যায় আমার ভাইয়ের বুক। রিন্টুর দু’জন বন্ধু জিল্লু ও রফিক মারাত্মকভাবে আহত হয়। পরে জিল্লুর কাছ থেকে জানতে পারি “আব্দুর রব সেরনিয়াতের পরিবারের সকলকে ড্রইং রুমে এক সাথে এক লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে এবং যতক্ষন পর্যন্ত মৃত্যু নিশ্চিত না হয়েছে ততক্ষন পর্যন্ত থেমে থেমে গুলি করতে থাকে। একপর্যায়ে ঘাতকরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আমাদেরকে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরী বিভাগে চিকিৎসারত অবস্থায় রিন্টু ও আমি পাশাপাশি বেডে ছিলাম। আমি একজনকে রিন্টুকে দেখিয়ে বলি ওর কি অবস্থা? তখন রিন্টু আমাকে বলে দোস্ত আমাকে একটু পানি খাওয়াবি? পানির জন্য আমার জীবন শেষ! দোস্ত আমি আর বাঁচবোনা। আমি বললাম রিন্টু আমারও তো একই অবস্থা। আমার সারা গায়ে অসংখ্য গুলি। আমি তো হাটতে-চলতে পারতেছিনা, আমি তোরে পানি খাওয়াবো কিভাবে? দাড়া দেখি কাউরে বলতে পারি কিনা। এটাই ছিল রিন্টুর সাথে আমার শেষ কথা, এরপর আমি তাকিয়ে দেখি রিন্টুর ঘাড়টা একপাশে হেলে গেছে”। এভাবেই নিভে যায় আমার ভাইয়ের জীবন প্রদীপ।
এ হত্যাকান্ডের কথা তখন পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতে পারিনি। ১৫ই আগস্ট সকাল ছয়টায় আমার ছোট খালু তৎকালীন সচিব মোয়াজ্জেম হোসেন, আমার ভাই ঝালকাঠী-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, ১৪দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য আলহাজ্ব আমির হোসেন আমুকে এই নারকীয় হত্যাকান্ডের কথা জানান। আমু দাদা আমার বড় ভাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন আব্দুস সবুর খানকে রিন্টুর অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেন। অতপর সবুর দাদা রিন্টুর মৃত্যু সংবাদ সবাইকে জানান। আমাদের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া, সবুর দাদা রিন্টুর মৃতদেহ পাওয়ার চেষ্টা করলে জানতে পারেন যে, তাকে ইতিমধ্যেই বনানী কবরস্থানে অন্য শহীদদের সাথে দাফন করা হয়েছে। আমার ভাইর মৃত্যুর শোকে আমাদের পুরো পরিবার স্তম্ভিত হয়ে যায়। ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা সবসময় ওর শোকে কেদেঁছেন। প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজ শেষে মাকে কাঁদতে দেখেছি।
রিন্টু আম-কাঁঠাল পছন্দ করতো বলে মা রিন্টুর মৃত্যুর পর আর কোনদিন আম-কাঁঠাল খাননি। রিন্টুকে মাত্র ১৭বছর বয়সে