‘মাকে বলবেন যুদ্ধে যাচ্ছি’

আকন মোঃ বসির
আকন মোঃ বসির, প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ২৬ মার্চ ২০১৮

নারী মুক্তিযোদ্ধা মনির হোসেন শিমুলপাথরথাটা নিউজ অনলাইন ডেস্কঃ
একাত্তরে চোখের সামনে বাবাকে মেরেছে পাকিস্তানি বর্বররা, দাদাকেও। প্রতিশোধ নিতে এরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন লায়লা পারভীন বানু। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এই নারী মুক্তিযোদ্ধা মনির হোসেন শিমুলকে বলেছেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের জীবন

মা-বাবা, পাঁচ ভাই, এক বোনের সুখী পরিবার। সবার বড় লায়লা পারভীন বানু পড়েন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষে। মেয়ে ডাক্তার হবে, অন্য ছেলেগুলোও মেধাবী বলে মা-বাবার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। রাজশাহীর ঘোড়ামারার সাগরপাড়ায় নিজ বাড়িতে থাকেন তাঁরা। বাবা আজিজুর রহমান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর, ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

দুর্যোগের কালো মেঘ নিয়ে একাত্তর এলো। ২৫ শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যার খবর আজিজুর রহমানের কাছে পৌঁছেছে, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাও শুনেছেন। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী রাজশাহীর এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আছে। স্ত্রী আনোয়ারা রহমান ও মেয়ে লায়লাকে যুদ্ধ শুরুর খবর দিয়ে তিনি বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, রাজশাহী সেনানিবাসের পাকিস্তানি সেনারা যেন শহরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ-ইপিআর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অস্ত্র হাতে সেনানিবাস ঘিরে রেখেছে।’

তখনো মেডিক্যাল কলেজ খোলা। আসা-যাওয়ার পথে মুক্তিফৌজদের অস্ত্র হাতে টহল দিতে দেখে মনে বল পান লায়লা। তবে পুরো শহরবাসীর মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে ১০ এপ্রিল বিকট শব্দে একটি যুদ্ধবিমান উড়ে গেল। গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক আবু খন্দকার সহকর্মীদের বললেন, ‘আপনারা পরিবার নিয়ে অফিসে চলে আসুন। এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।’ ছেলেদের বাড়িতে রেখে বয়স্ক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে পুঠিয়া রাজবাড়ির অফিসে চলে এলেন আজিজ সাহেব। পুলিশ, গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯০টি পরিবার আশ্রয় নিল এই বিরাট বাড়িতে। তাঁরা ভাবলেন, সহকর্মীদের পরিবারগুলোকে দেখে হয়তো পাকিস্তানি সেনাদের মনে দয়া হবে, অফিসে হামলা করার আগে অন্তত একবার ভাববে, পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করবে। কিন্তু সে সবের কিছুই ঘটল না।

সড়কপথের বাধা ডিঙাতে না পেরে ১৩ এপ্রিল পদ্মা নদী হয়ে রাজশাহীতে পৌঁছাল সেনার দল। সেনানিবাস দখল করল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আত্মদান করলেন।

১৪ এপ্রিল সকাল ৮টায় বেয়নেট দিয়ে রাজবাড়ির মূল ফটক ভেঙে ফেলল ওরা। আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন ভেতরের অসহায় মানুষগুলো। ২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য, অফিসার ভেতরে ঢুকেই একে একে সবার পরিচয় জেনে নিল। তারা অস্ত্রাগার দখলে নিয়ে এলো। আতঙ্ক ছড়াতে ভাঙচুর শুরু করল। ভয়ে মানুষগুলো কাঁপছে, মেয়েরা কাঁদছে। পালানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।

হায়েনারা সকাল সাড়ে ১০টায় একে একে পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডেকে গেটের বাইরে নিয়ে গেল। আজিজুর রহমান, আবু খন্দকারও আছেন। পরস্পরের দিকে তাকালেন পাঁচজন, মুখে ভাষা নেই, চোখগুলো স্থির। জানেন এখনই হয়তো জীবনের শেষ ক্ষণ। ভেতরে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা দরজা-জানালার আড়ালে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়জনের জীবন ভিক্ষা করছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে, প্রিয়তম স্বজনের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে তাঁদের গুলি করা হলো। একবারও পেছনে না তাকিয়ে জিপে উঠে গেল হায়েনার দল। ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন আবু খন্দকার ও আজিজুর রহমান। গুরুতর আহত তিন পুলিশ কর্মকর্তা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, আহত স্থান চেপে মাটি কামড়ে একটু একটু করে গেটের ভেতরে ঢুকলেন। অন্যরা ধরাধরি করে তাঁদের নিয়ে এলেন। গেট টেনে বন্ধ করে দেওয়া হলো। বাবার ভয়ংকর মৃত্যুর কষ্ট সয়ে লায়লা তাঁদের চিকিৎসা করলেন। এরপর আবু খন্দকারের মেয়েসহ তিনি কাঁদতে কাঁদতে পড়ে থাকা তাঁদের বাবার লাশ দাফনের জন্য অনুরোধ জানালেন জনে জনে। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর সাহসী পুলিশ সদস্যরাও এগিয়ে আসার সাহস পেলেন না। সবাই তাঁদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, বাড়ির সামনে লাশ থাকলে হানাদার বাহিনীর অন্যরা এলেও ভেতরে ঢুকবে না। পুরোটা দিন সবার চোখের সামনে দুুই সহকর্মীর মরদেহ পড়ে রইল। শহরে জনমানুষের চিহ্নও নেই, কারফিউ চলছে। রোদের তাপে লাশগুলো ফুলে উঠল। রাতে গেট খোলার শব্দে ১৫ থেকে ২০ জন কিশোরী-তরুণী সম্ভ্রম বাঁচাতে জবা গাছগুলোর আড়ালে লুকালেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের ঘরে ঘরে খুঁজে না পেয়ে গালাগাল দিয়ে ফিরে গেল। তুমুল বৃষ্টিতে সারা রাত ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন তাঁরা। সকালে ফিরে দেখেন, ফুলে গিয়ে লাশগুলোর চামড়া ফেটে গেছে। সারা দিন ধরে লাশ দাফনের জন্য কাঁদলেন। তবে কারোর এগোনোর সাহস হলো না।

দুপুর ১২টায় বিকট শব্দে দুটি ট্রাক গেটের সামনে থামল। লাশে ভরা ট্রাকে তারা এই লাশগুলোও উঠিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল। তবে বিকট গন্ধ, পচে যাওয়া বলে সামান্য গর্ত করে কোনো রকমে মাটিচাপা দিয়ে ফিরে গেল পাকিস্তানি বাহিনী। জুমার নামাজের জন্য কারফিউ তুলে দেওয়া হলে সবাই বেরিয়ে এলেন। অন্য সহকর্মীদের নিয়ে বাবার লাশগুলো তুলে আনলেন দুই মেয়ে। গর্তগুলো আরো বড় করে যথাসম্ভব ভালোভাবে লাশ মাটিচাপা দিয়ে জানাজা হলো। এক পুলিশ সদস্য সাহস করে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আতঙ্কে কাটতে লাগল দিন। দাদা পিজার উদ্দিন মণ্ডল ছোট ছেলে কুতুব উদ্দিনের মাধ্যমে বউমার কাছে খবর পাঠালেন, ‘গ্রামে চলে এসো।’ তবে স্বামীহারা বধূ বাড়ি ছাড়া সম্বল নেই বলে সেটির দখল রাখতে তিন ছেলেকে নিয়ে রয়ে গেলেন। লায়লাকে দাদাবাড়ি পৌঁছে আবার মায়ের কাছে ফিরে এলেন আরেক ছেলে।

মাথাভাঙা নদীর তীরে ধর্মধহ গ্রামে দাদাবাড়ি। সেখানেও কয়দিন পরে রাজাকারদের নিয়ে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনারা। দিনে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ায়; হত্যা, ধর্ষণ করে। ওদের আসার খবর পেলেই গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে ওপারের করিমপুর, কামারপাড়ার গ্রামে চলে যায়। ওরা ফিরে গেলে সন্ধ্যায় ফিরে আসে। সারা দিন না খাওয়া মেয়েগুলো রান্না করে দুটি মুখে দেয়। মাসখানেক এভাবেই চলল। ২৩ মে রাতে বর্বররা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিল। নাতনিকে ওপারে চলে যেতে বলে বৃদ্ধ দাদা থেকে গেলেন। ভোরে লায়লা ফিরে দেখেন, গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে পরনের লুঙ্গি দিয়েই দাদাকে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

তখনই কাকার হাতে চিঠি দিয়ে বললেন, ‘মাকে দিয়ে বলবেন, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি।’

ওপারে গিয়ে পথে পথে হাঁটতে লাগলেন। এক খ্রিস্টান পরিবার ক্ষুধার্ত, এক কাপড়ের মেয়েকে ডেকে খাওয়ালো, কাপড় দিল। সে বাড়িতে কয়দিন থেকে পথচলতি মানুষের সাহায্যে তিনি কলকাতায় পৌঁছালেন। থিয়েটার রোডে গিয়ে বাবার বন্ধু মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি সেখানে কাজের ব্যবস্থা করলেও লায়লা বারবার বলেছেন, ‘চাচা, কাজ চাই না, অস্ত্র চালানো শিখতে চাই। আমি মুক্তিযুদ্ধ করব।’ ফলে তাঁকে গোবরার নারী মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হলো। তাঁদের সংগঠক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। কলকাতার নকশালদের পরিত্যক্ত বাড়িতে তাঁরা থাকেন। প্রত্যেকের জন্য কম দামের দুটি প্রিন্টের শাড়ি, মগ ও কম্বল বরাদ্দ। কম্বল বিছিয়ে রাতে মেঝেতে ঘুমান। সকালে এক মগ চা, দুপুর-রাতে কাঁকরভর্তি ভাত, সামান্য ডাল, কালেভদ্রে সবজি জোটে।

ভোর ৫টায় আধপেটা মেয়েদের ঘুম থেকে তুলে ব্যায়াম শেখানো হয়। দলে ভাগ করে গাছ বাওয়া, সাঁতার প্রশিক্ষণ; থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো শেখানো হয়। লায়লা অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা করা শেখান। একটি দল শিলাইদহের বি আর সিংহ রেলওয়ে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন করা শিখলেন। কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে শেখা অপারেশন ফিরে এসে তাঁরা সহযোদ্ধাদের শেখালেন। স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যোগ দেওয়ায় নারী মুক্তিযোদ্ধা ২০০ ছাড়িয়ে গেল। ১৬ জনের প্রথম দলকে আগরতলা ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় পাঠানো হলো।

অন্যদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও চিকিৎসাসেবা শেখানোর জন্য লায়লাকে রেখে দেওয়া হলো। তবে তিনি প্রশিক্ষণ শিবির ও মুজিবনগর সরকারের মধ্যে যোগাযোগ, নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য শিবিরে প্রেরণ, বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য প্রদান, ফিল্ড হাসপাতালের জন্য হাসপাতাল-ফার্মেসি ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করতেন। ২০০ মেয়েকে তিনি প্রশিক্ষণ শিবিরে চিকিৎসাসেবা দান করা শিখিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর একাত্তরের ডিসেম্বরে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁকে নতুন করে সংগ্রামে নামতে হলো। মেডিক্যালে পড়ার পাশাপাশি পরিবারের খরচ চালাতে টিউশনি করতেন, মা-ও নানা কাজ করেছেন। তবে কোনো দিন এই দুই সংগ্রামী নারী পরস্পরকে একাত্তরের জীবন বলেননি। শুধু ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা বললেন, ‘ঘরের সম্বল বিক্রি করে পানি-ভাত খেয়ে তখন আমরা দিন কাটিয়েছি। তোর চাচারা খোঁজও নিতে আসেনি। বাড়ি খালি করে দেওয়ার জন্য বিহারি, রাজাকারদের হাতে প্রতিদিন মার খেতে হয়েছে। তা-ও ভিটে ছাড়িনি।’ দাদার সম্পত্তিও পাননি তাঁরা। (সূত্রঃ কালের কন্ঠ)

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/২৬ মার্চ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)