অবৈধ জাল বন্ধ না করে মৎস্য অবরোধ দিয়ে লাভ কি? কর্মশালায় প্রশ্ন জেলেদের
সাগর ও নদীর চরে নিষিদ্ধ মিহি ফাঁসের গড়া জাল, বেহুন্দী, কারেন্ট জাল ও বেড় জাল পেতে ধ্বংস করা হচ্ছে লাখ লাখ মাছের রেণু ও পোনা। এছাড়াও বিস্তীর্ণ চরে খাবার খেতে গিয়ে এসব জালে মারা পড়ছে ইলিশের বাচ্চা (জাটকা)। যা নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি করা হয় বলে অভিযোগ গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করা জেলেদের। তবে মৎস্য বিভাগের দাবি ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে তাদের প্রতিহতের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
গতকাল সোমবার সকালে দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের আয়োজনে উপকূলীয় জেলেদের নিয়ে ‘২০ মে থেকে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সকল প্রজাতির মৎস্য এবং ক্রাস্টেসিয়ান্স আহরন নিষিদ্ধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কর্মশালায়’ এ অভিযোগ করেন তারা। এসময় উপস্থিত বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদারের কাছে জেলেরা জানতে চান অবৈধ জাল বন্ধ না করে মৎস্য অবরোধ দিয়ে লাভ কি?
জেলেরা অভিযোগ করেন নৌপুলিশ ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চলমান নিষিদ্ধ জাল বন্ধ না করে ৬৫ দিনের অবরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা বলেন এক শ্রেণির অসাধু জেলে সাগর ও নদীতীরবর্তী চরগুলোয় জোয়ার-ভাটার সময় ওই সব নিষিদ্ধ জাল পেতে মাছের বংশ ধ্বংস করছে। এতে এক শ্রেণির প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়া আছে। প্রশাসন দিনে টহল দিলেও রাতে বেপরোয়া হয় এই জেলেরা।
স্থানীয় আড়ৎদাড় শাহ আলম টিপু বলেন, দুই দিকে বলেশ্বর ও বিশখালী নদী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত পাথরঘাটায় রয়েছে অসংখ্য চর। এই চর ও খালের তীর গুলোয় খুঁটি গেড়ে ‘গড়া জাল’ (স্থানীয় নাম ‘ঘোপজাল’ বা ‘চরগড়া’) পাতা হয়। দুই-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হয় একেকটি জাল। ভাটার সময় জাল খুঁটির নিচে বেঁধে রাখা হয়। ভরা জোয়ারে নদী বা সাগরের লাখ লাখ রেণু, পোনা বা ছোট মাছ বালু ও উদ্ভিদকণা খেতে চরে আসে। তখন ওই জালের ওপরের অংশ খুঁটির মাথায় বেঁধে দেওয়া হয়। ভাটায় পানি শুকিয়ে গেলে জালে আটকা পড়ে ওই সব রেণু, পোনা বা ছোট মাছ। বিক্রয় যোগ্য মাছ তুলে স্থানীয় বাজারে নেওয়া হয় আর মরা রেণু বা পোনা ফেলে দেওয়া হয় পানিতে। এর মধ্যে যেসব পোনা ও আমাছা মাছ বিক্রি হয় না সেসব শুকিয়ে শুটকি বানিয়ে ফিশমিল ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বেচে দেওয়া হয়। যা কয়েক কোটি পোনা মিলিয়ে এক কেজি ওজন হয়। যার দাম হয় ৩০ টাকা।
অনুমোদন ছাড়াই সংরক্ষিত বন পেরিয়ে প্রসাশনের সবাইকে ম্যানেজ করে বলেশ্বর ও বিষখালী নদী এবং বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমস্থলে বিস্তীর্ণ চরে শত শত অবৈধ গড়া জাল পেতে রাখা হয় বলে অভিযোগ করেন মৎস্য পাইকার নজরুল ইসলাম। এ বিষয়ে দক্ষিণ স্টেশন কোস্টগার্ড কমান্ডার লেফটেনেন্ট ফাহিম শাহরিয়ার জানান, নিষিদ্ধ জাল বন্ধ করতে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে জনবলের অভাবে আমরা শতভাগ সফল হতে পারছিনা।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, বলেশ্বর ও বিশখালী নদীর বিভিন্ন চর, সাগর মোহনার লালদিয়ার বিস্তীর্ণ চরের কোনো স্থান ফাঁকা থাকে না। জোয়ারের পানিতে মাছ কূলের দিকে এলেই গড়া জাল, বেহুন্দী জাল ও বেড় জালে আটকা পড়ে মারা যায়। যা বার মাস এভাবে চলতে থাকে। একারণে নদী সমুদ্রে মাছের পরিমাণ কমে গেছে। বিএফডিসিত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রর ব্যাবস্থাপক লেফটেন্যান্ট লুৎফর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন অবৈধ জালের বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরের তুলনায় এ পাইকার বাজারে অর্ধেকের কম মাছ বিক্রি হচ্ছে।
বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক মৎস্য আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, বেহুন্দী, গড়া জাল, কারেন্ট জাল ও বেড় জাল সব সময়ই নিষিদ্ধ।মাছের রেণু-পোনা রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ ক্রমান্বয়ে সফল হচ্ছে। তবে জনসচেতনতা ছাড়া এসব নিধন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা অসম্ভব। নিষিদ্ধ জাল ধংসের ক্ষেত্রে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশকে দেশীয় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা সুলতানা, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু, মৎস্য আড়ৎদাড় সমিতির সভাপতি, জাহাঙ্গীর হোসেন জোমাদ্দার প্রমুখ