৬ বছরেও বিচার পায়নি নির্যাতিত পরিবার
বরগুনার পাথরঘাটা পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ১ ও পাথরঘাটা পৌর ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং বাংলাদেশ মৎস্য কর্পেরেশন পাথরঘাটা (বিএফডিসি) ঘাট শ্রমিক সভাপতি ও সদ্য বহিস্কৃত জাতীয় শ্রমিক লীগের পাথরঘাটা উপজেলা সভাপতি মােস্তাফিজুর রহমান সােহেল!
২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পাথরঘাটা আদর্শ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে সােহেল সহ তার সহযােগীরা অপহরণ করে আটকে রাখে।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায় , নির্যাতিতার মা মাহমুদা বেগম নিজে বাদি হয়ে সোহেলসহ ১৪ জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করে । মামলার ৬ বছর পার হয়ে গেলেও বিচার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার, উল্টো বিভিন্ন সময় তাদের হুমকি ও হয়রানীসহ সকল রকমের ভয় দেখিয়ে আসছে সোহেল ও তার বাহিনী।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ ঐ সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলায় সোহেল অত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে গেলে আদালত সােহেলকে জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠান।
মামলার বাদি মাহমুদা বেগম বলেন, সোহেলের অনেক অবৈধ টাকা আছে, সে টাকা পয়সা দিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন আমলাদের দিয়ে তদবির করে জামিনে বের হয়ে যায়। সে জামিনে আসার পর থেকে অনবরত মামলা তুলে ফেলার হুমকি দেয়
এ সময় ওই মামলার বাদী মাহমুদা বেগম সংবাদ সম্মেলন করে নিরাপত্তা দাবি করে।
২৬ মে ২০১৪ সালে মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করা হলেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে শিশু শিক্ষার্থীর মা মাহমুদা বেগম পাথরঘাটা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে, পাথরঘাটা থানায় গত ২৪ মে ২০১৪ সালে ঐ মর্মে তিনি সাধারণ ডায়েরী করেন।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাথরঘাটা বিএফডিসিতে গত ১০ বছরে প্রায় শতাধীক কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়ার তথ্য ঘটশ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা বরগুনা-২ সাংসদ শওকত হাচানুর রহমান রিমনের কাছে প্রকাশ করে। এ সময় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল জিম্মি করে এই অনিয়ম চালাচ্ছে মর্মে লিখিত অভিযোগ করেন তারা। লিখিত অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান চালায় সাংসদ রিমন। বেরিয়ে আসে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির আলামত। এতে নাম উঠে আসে পাথরঘাটা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের। বিষয়টি নিয়ে যতই অনুসন্ধান চালায় ততই অনিয়মের তথ্য ও প্রকাশ পেতে থাকে। এ নিয়ে তিনি প্রায় ৮টি কমিটি করে সে কমিটির মাধ্যমে সোহেল বিএফডিসি ঘট থেকে অর্থ আত্নসাত করেন।
দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসি। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় এ মৎস্য বন্দরটি পরিচালিত হয়ে আসছে । মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় ১৯৮১ সালে নির্মিত। সেই থেকে বঙ্গোপসাগর, বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদীসহ তৎসংলগ্ন নদ-নদীর মাছ বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটে এসে বিক্রি করা হয়। এই ঘাটে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রিহয়। এর থেকে প্রচুর পরিমাণ সরকার রাজস্ব আহরণ করে থাকেন।
এই মৎস্য অবতরণটিকে কেন্দ্র করে ট্রলার মালিক সমিতি, মাঝি সমিতি, আড়ৎদার সমিতি, পাইকার সমিতি, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট,
লৈট্টা সমিতি, বরফ সমিতি, ভ্যান সমিতি, ককশেড সমিতি, হুক সমিতি, ঝুড়ি সমিতি, বেলচা সমিতি সহ নামে-বেনামে কয়েকটি সমিতি গড়ে ওঠে। যার সকল কিছুর প্রধান নেতৃত্বে ছিল মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে এই সংশ্লিষ্ট সকল সমিতির নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন সাংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমন। শুনেছেন তাদের অভিযোগগুলো। এতে করে বেরিয়ে আসে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সকল সমিতি ভেঙ্গে আহব্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএফডিসিকে স্বাধীন ঘোষণা দেন তিনি।
আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জমাদ্দার জানান, আমি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণ করত মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। ও তার বাবা পাথরঘাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নরুল আমিন। আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে ছিলাম এবং কাঠের পুতুলের মতো আমাকে বসিয়ে রেখেছে সে। যখন যেভাবে চালাতো সেভাবেই চলতে হয়। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে এমপি রিমনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করলে এই টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলে।
এতো টাকা আয়ের উৎস ছিল মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নামে-বেনামে বিভিন্ন সমিতি। এই সমিতির নাম ভেঙ্গেই প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতো মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত টাকা আদায়, ককশেট প্রতি নির্ধারিত টাকা, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের উন্নয়নের নামেও প্রতিদিন আদায় হতো কয়েক লাখ টাকা।
এ নিয়েও ব্যাবসায়ীরা এমপি রিমনের কাছে অভিযোগ করে জানান , মাছ কিনতে হলে সোহেলকে সব পাইকার প্রতি মণে ৩শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে পাইকারদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫/২০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। তার চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষা পায় না খেটে খাওয়া দিনমজুররাও। অভাব যাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় সেই দিনমজুরদের শরীর ঘাম বিক্রি করে নিজের পকেট ভরেন সোহেল।
তার সংগঠনের সদস্য ব্যতীত কোন শ্রমিক ঘাটে কাজ করার সুযোগ পায় না। আর যারা সদস্য হয় তাদের দৈনিক মজুরি ৬০০/৭০০ হলেও দিন শেষে ভাগ্যে জোটে মাত্র ২০০/৩০০ টাকা। এর প্রতিবাদ করলে শ্রমিকদের ঘাটে কাজ করতে দেয় না সোহেল। সাথে তাদের বিএফডিসি ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য পদ বাতিলে হুমকি দামকি দেয়, মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের সময় আড়তদারদের কাছ থেকে প্রতি লাখে নেয়া হয় ৫০০ টাকা। নতুন করে শ্রমিক ডুকতে চাইলে তাদের কাছ অফেরতযোগ্য থেকে ৫ থেকে ৭হাজার নিত সে। বরফ ব্যবসায়ীদের দিকেও কুদৃষ্টি রয়েছে সোহেলের। ক্যান প্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০ টাকা।
পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ বহন করতে হলে কার্টুন প্রতি ২০০ টাকা