আলাদা হওয়ার ভয়ে এখনো বিয়েই করেননি ২ ভাই
না, এটা কোনো সিনেমা বা নাটকের গল্প নয়। বাস্তবে দুই ভাইয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মৃণাল কান্তি বসু ও দিপক কান্তি বসু। ঠিক যেন রাম-লক্ষণ। দুই ভাই আলাদা হয়ে পড়বেন এমন আশঙ্কায় জীবনে বিয়েও করেননি। অবশ্য বিয়ে নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আক্ষেপও নেই। অর্ধশতাব্দী ধরে একসঙ্গে পথ চলছেন তারা, যা অব্যাহত রয়েছে এখনো।
ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই একসঙ্গে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া করেন। সাদা মনের এই দুই ভাইকে এলাকাবাসী রাম-লক্ষণ, মানিক-জোড়সহ বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুই ভাই ঘুরে বেড়ান একেক এলাকায়। বিশ্রামাগার বলতে বিভিন্ন মন্দির বা আশ্রম।
মৃণাল কান্তি বসু ও দিপক কান্তি বসুর আদি নিবাস খুলনার পাইকগাছার হরিঢালী গ্রামে হলেও তালা উপজেলার কানাইদিয়া গ্রামে প্রায় ৩০ বছর ধরে তাদের বসবাস। প্রয়োজনের বাইরে কারো সাথে কথা বলেন না এ সহোদর। নিজেদের পৈত্রিক জমি উদ্ধারের জন্য তারা মামলা চালাতে নিয়মিত পায়ে হেঁটে খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন।
পাইকগাছা উপজেলা সেনেটারী কর্মকর্তা উদয় মণ্ডল বলেন, ছোটবেলা থেকে মৃণাল কান্তি বসুকে আমরা সাহেব দা’ নামেই জানতাম। এমনকি জন্মের পর থেকে তাকে আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার বলেই জেনেছি। তবে বড় হওয়ার পর জানতে পারি সাহেব দা’রা আমাদের বাড়ির কেউ নন।
জানা গেছে, মৃণাল কান্তি বসু ও দিপক কান্তি বসুর পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। আদি নিবাস পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী গ্রামের হলেও প্রায় ৩০ বছর তালার কানাইদিয়া গ্রামে তাদের বসবাস। পোশাক-পরিচ্ছদ, আচরণ-চলনে রয়েছে সেই আভিজাত্য। ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই সংসার বিবাগী। নিজের বলতে হাতের দুটি ব্যাগ ও পরিধেয় বস্ত্র। সর্বহারা হলেও কারো কাছ থেকে সাহায্য নেন না তারা। শোনা যায়, গোপনে একটি বুনিয়াদী পরিবারের সামান্য সহযোগিতায় চলে তাদের জীবন। পরিচিত বুনিয়াদী ছাড়া বিশেষ কারো সঙ্গে কথাও বলেন না তারা। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের পরিপাটি বলে মনে হয়। কখনো কখনো সান্ত্বনা পেতে ছুটে যান পৈত্রিক নিবাস হরিঢালীতে।
স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় ফিরলেও পুরাতন বাড়িতে প্রবেশ করেন না মৃণাল-দিপক। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার ফিরে আসেন পথে। আসলে পথই যেন তাদের আসল ঠিকানা। নির্লোভী দুই ভাই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েন, চিরচেনা সেই রাজহংসীর রাজকীয় দুলকিতে সামনে-পিছে করে ছুটে চলেন সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
স্থানীয় শিক্ষক সমীরণ বলেন, এক সময় সাহেব (মৃণাল) ভারতে রেলওয়েতে চাকুরি করতেন। প্রায় ৫ বছর পর চাকুরি ছেড়ে গ্রামে এসে আর ফিরে যায়নি। হরিঢালী পুলিশ ক্যাম্পের পাশে তাদের জায়গা-জমি ছিল। পরবর্তীতে সেটা স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে নিয়েছে। এ নিয়ে এখনো মৃণাল-দিপকরা খুলনা জজ কোর্টে মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর সিদ্দিকী রাজু বলেন, আমার আব্বা যখন চেয়ারম্যান ছিল তখন থেকে শুনছি দুই ভাইয়ের পৈত্রিক জমি নিয়ে ঝামেলা চলছে। এ নিয়ে ঐ সময় অনেক দেন-দরবারও হয়েছে। তবে দীর্ঘ কালক্ষেপণে জমির কাগজপত্র তৈরি হয়ে এরইমধ্যে তা বেচাকেনাও হয়ে গেছে।
শেষে জীবনে দুই ভাইকে পথে পথে ঘুরতে দেখে কৌতুহলী অনেকেই তাদের মৌলিক চাহিদার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। অনেকেই বলেন, পয়সার অভাবে মামলার কাজে জেলা শহরে যেতে দুই ভাই এখনো পায়ে হেঁটে পৌঁছান গন্তব্যে। এখন আর আগের মতো চোখে ভাল দেখেন না। কানেও কম শোনেন। শেষ সময়ে তাদের অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রয়োজন।