সিডর দিবস দক্ষিণাঞ্চলে নভেম্বর মাসেই ১১ ঘূর্ণিঝড়
শফিকুল ইসলাম ইরান,
উপকূলীয় জেলা বরগুনায় একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বিষখালী নদীপারের মানুষ। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ।
জানা যায়, ১৯০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসেই মোট ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানী, বন্য ও গৃহপালিত পশুর মৃত্যু ও সম্পদহানি ঘটে। এর মধ্যে সর্বশেষ আঘাত হানা ‘বুলবুল’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের তথ্যেও বেশ আতঙ্কিত ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রগ্রামের (সিডিএমপি) দুর্যোগ কোষ থেকে জানা যায়। ১৯০৪ সালের নভেম্বরে সোনাদিয়ার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু এবং বহু মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সেই সঙ্গে বিষখালী নদীতে বিলীন হয় দুইশাতাধিক বসতবাড়ি।
১৯৭০-এর নভেম্বরের ১৩ তারিখে দেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্র্ণিঝড় হারিকেন সরকারি হিসাব অনুযায়ী দুর্যোগ আক্রান্ত জেলা ও উপজেলা গুলোতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এবং ৩৫ হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭২ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হারিকেন নামক এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মি.।
১৯৭১ সালে ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদি পশুর প্রানহানী ঘটে (ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি)। বেতাগীর চরখালী ও মাছুয়াখালীতে ব্যাপক গবাদি পশু মারা যায়। ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর বরগুনা জেলাসহ সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৫-১১৩ কিমি. বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। ১-২ মি. উচ্চতার জলোচ্ছাস হয়। ১৯৭৪ সালে ২৪-২৮ নভেম্বর সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা, এবং কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কিমি. বেগে ঘূর্ণিঝড় ও ৩-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছাস আঘাত হানে।
১৯৮৩ সালে প্রতি ঘণ্টায় ১৩৬ কিমি. বেগে বায়ু প্রবাহ ও ২ মিটার উঁচু জলোচ্ছাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বেতাগী, বরগুনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীসহ কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিম্নঞ্চলের দিকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের ৮-৯ নভেম্বরে বরগুনা, বেতাগী বরিশাল, পটুয়াখালীসহ চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পরে। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিমি. এবং খুলনায় ৯০ কিমি. বরিশালে ৮০ কিমি.। ১৯৮৮ সালের ২৪-৩০ নভেম্বরে বরিশালের চরাঞ্চলসহ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনার ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিমি. বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মোংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছাস হয়। এতে ৫ হাজার ৭০৮ জন নিহত হয় এবং ৬৫ হাজার গবাদি পশু মারা যায়।
১৯৯৫ সালের ২১-২৫ নভেম্বরে উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিমি. বেগে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করকারী সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে। একযুগ অতিক্রম হলেও সেই আতঙ্ক এখনও ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ। বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী বরগুনা, বেতাগী, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, বাগেরহাটসহ পিরোজপুর জেলা এই সুপার সাইক্লোন সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারাদেশে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক মারা যায়। নিখোঁজ হয় ১ হাজার ৩ জন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ধ্বংস হয় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি, দুই লাখ দশ হাজার হেক্টর জমির ফসল। মারা যায় সুন্দরবনের বিপুলসংখ্যক প্রানী।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এবং ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। এ ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ বেতাগীতে মারাত্মক ক্ষতি না হলেও বিগত ঝড়ের কথা ভেবে আতঙ্কিত ছিল বিষখালী নদীপাড়ের মানুষ।