ধর্ষণ এখন সামাজিক নয় রাষ্ট্রীয় ব্যাধি!
শফিকুল ইসলাম খোকন
ধর্ষণ… শব্দটি শুনতে খারাপ লাগে, এর কাজ ধরণও দুটোই খারাপ। যা ন্যাক্কার জনক ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যা একটি নারীর জন্য কলঙ্ক, জীবনের জন্য একটি কালো অধ্যায়; ধর্ষণ খুব খারাপ বিষয় হলেও আজ তা অতি পরিচিত।
ধর্ষণ করছে একজন চরিত্রহীন, লম্পট, ভালো মানুষের আড়ালে মস্তিস্ক বিকৃত
লোক, কিন্তু দায়ী হয়ে যায় পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র। ধর্ষণ এখন এমন অবস্থায় এসে গেছে এটি এখন সামাজিক ব্যাধি নয় রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভির সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায় চোখে
পড়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা বিষয়ক খবর। এ সংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে
মানুষের মন বিষিয়ে উঠেছে রীতি মতো। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃটান্ত মূলক
শাস্তি না হওয়ায় শতকরা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ অশ্লীলতায় আইয়ামে
জাহেলিয়াতের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক
মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্রী থেকে শুরু করে চার-পাঁচ বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ও ধর্ষণ করার ঘটনা তো সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান সম্মানের ভয়ে বিষয়টি
কাউকে জানায় না। তখন বিষয়টি লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকে। এরপরও যে খন্ডিত
চিত্র সমাজের কাছে ভেসে উঠে তা ভয়ানক।
সবশেষ নোয়াখালীতে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আর এ ঘটনার পর সোমবার (৫ অক্টোবর) সকালে, বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ভিডিওটি সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সময় হাইকোর্ট প্রশ্ন করেন, ‘এক মাস এই ঘটনা চাপা থাকলো কি করে, পুলিশ কি করছে। ফেসবুকে না ছড়ালে তো ঘটনা গোপনই থাকতো।’ এ মামলায় প্রধান আসামি বাদলকে ঢাকা এবং দেলোয়ারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। না; আমি বলেছিলাম সবশেষ ঘটনা। না এ
ঘটনাইশেষ নয়। হয়তো আরও দেখতে হবে এ রকমের ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন ঘটনা কি বন্ধ করা যায়না?
গণপরিবহণ, নৌযানসহ বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি সবচেয়ে নিরাপদ বাবাÐমায়ের কাছে
থেকেও নারীÐশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বহুল আলোচিত হয়ে
উঠেছে ধর্ষন শব্দটি। ধর্ষন এখন ডাল-ভাতের মত হয়ে উটেছে। ধর্ষণ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার ধর্ষন বলতে আমরা কী বুঝি বা ধর্ষণ কী?
ধর্ষণ বলতে আমরা যা বুঝি তাহলো ’কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে জোরপূর্বক
শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যৌন তৃপ্তি লাভ করা।’ বর্তমান সমাজে অহরহই ঘটছে এমন লজ্জাজনক ঘটনা। নারীরা লাঞ্ছিত হচ্ছে যেখানে সেখানে। দিন দিন বেড়েই চলেছে এমন ন্যাক্কাড়জনক কাজ। এ সকল কাজের নেপথ্যে কী কী কারণ রয়েছ কে বা কারা দায়ী তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? নানামুখি কারণে ধর্ষনের মত এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্টে ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণের কথা বলা হয়। বাস, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা ও ট্রাকে এসব ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গণপরিবহনের চালক হেলপার সহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণ ধর্ষণ ৮টি
ধর্ষণ ও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের দেয়া পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষনের শিকার হয়েছে। ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জন কে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ শিশু কিশোরী। এর মধ্যে ৬ থেকে ১২ বছরের মেয়ে বেশী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারীর ১৮ দিনে ২৩টি ধর্ষণের চেষ্টার খবর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জন শিশু কিশোর।
ধর্ষনের পর হত্যার শিকার হয় এরাই বেশি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ
কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের
শিকার হয়েছেন৷ ওই বছর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬জনকে৷ আর আত্মহত্যা
করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী৷ একই বছর যৌন হয়ানারীর শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী৷ ২০১৯ যৌন হয়রানীর শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন৷ প্রতিবাদ
করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন৷ যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ
করতে গিয়ে ৪৪ পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ সবশেষ ২০২০ সালের গত আট
মাসে প্রায় ৯০০ নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এতে উদ্বেগ জানিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও নারীর প্রতি মর্যাদা না থাকায় একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে কতটাই বা শাস্তি হয়েছে বা হচ্ছে। আমাদের প্রচলিত আইন কী এ অনাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে? বাংলাদেশের আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। তবে আইন জানা ও আইনের প্রায়োগিক দিক না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তা অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯ (২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী
কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।’ একই সঙ্গে জরিমানার কথাও আছে সর্বনিু জরিমানা ১ লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ওই ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড, কমপক্ষে ১ লাখ টাকা
জরিমানা হবে।’ এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- এত কঠিন আইন থাকাসত্ত্বে শুধু প্রয়োগের অভাবে এ জঘন্য অপরাধের বিচার হচ্ছে না। এ কথা থেকেই বুঝা যায় আমরা যেমন একজন নারীর প্রতি সম্মান দেখাই না, তেমনি এই আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল নয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার কারণে এবং অপব্যবহারের ফলে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হয়না। ঘটনার পর মামলার বিবরণ, পরে চার্জশীট এবং আদালতে সাক্ষ গ্রহণে প্রকৃত ঘটনা আড়ালের কারণে ফাকফোকর থেকে বেড়িয়ে আসে অপরাধীরা।
কি এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দিনাতিপাত করছি। তবে আমাদের মধ্যে
মস্তবড় এক গলদ রয়েছে-রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সদিইচ্ছার ভিতরে। সেই গলদের নাম
বিচারহীন সংস্কৃতি। তুচ্ছ কারণে ধর্ষনের মত ঘটনা তখনই সংঘটিত হয়, যখন রাষ্ট্রে বিচারহীনতার পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এ সমাস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ কারণে যে, এই দেশে ধর্ষনের বিচার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও দীর্ঘ সূত্রতা এখন প্রকট। ধর্ষনের পিছনে যেসকল
কারণকে দায়ী করবো তাহলো নৈতিকতার অভাব বা অবক্ষয়, নারীদের সচেতনতার অভাব, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি না দেয়া, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধের অভাব,
নারীর খোলামেলা ও আবেদনময়ী পোশাক পরিধান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার
সুযোগ, সন্তানে প্রতি পিতা-মাতার উদাসহীনতা ইত্যাদি। তাছাড়া প্রযুক্তিতো
রয়েছেই। এরকম নানান কারণে ঘটছে ধর্ষনের ঘটনা লাঞ্ছিত হচ্ছে নারীরা।
অনেকেই বলছেন বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হচেছ ‘ধর্ষণ একটি সামাজিক
ব্যাধি’। আমি বলবো না এটি সামাজিক ব্যাধি নয়, ধর্ষণ এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে। এ অপরাধ পুরো রাষ্ট্রের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে। ধর্ষককে কেবল মৃত্যূদন্ড নয় এ দন্ডের আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহীর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা উচিত। এটি প্রথমে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।
বিশ্বের কাছে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে অপরাধী করে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ধর্ষণ এখন আর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে নেই। ধর্ষণ প্রতিরোধে যা প্রয়োজন বলে মনে হয় তাহল সকলের মাঝে নৈতিকতাবোধ জাগরণ। যা এখন আর নেই। আমাদের নৈতিকতা শেষ হয়ে গেছে।
ইসলাম সহ কোন ধর্মেই ধর্ষনের মতো কাজকে উৎসাহিত করা হয়নি। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রবল গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ধর্মীয় অনুশাষন মেনে চলার মাধ্যমে
নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার মাধ্যমে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব সৃষ্টিই পারে ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা রাখতে।
পরিশেষে বলতে চাই অপরাধী শাস্তি না পেলে সে বারবার অপরাধমুলক কাজ করে
তাতে অপরাধ বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে অন্যরা অপরাধে জড়াতে উৎসাহিত হয়। তাই
ধর্ষনকারীকে বিচরের মাধ্যমে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা
প্রয়োজন যাতে অন্যরা ভবিষ্যতে এমনটি করার সাহস না পায়। অপরাধ করে পার
পাওয়া যায়- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটা শুধু
পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যে কোনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের রাশ টেনে ধরার জন্য প্রথম কর্তব্য এসবের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার ওসচেতনতা সৃষ্টি।
লেখক [সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক]
msi.khokonp@gmail.com