পাথরঘাটা তালতলী কুয়াকাটা গলাচিপা জমজমাট রুট ইয়াবায় ভাসছে উপকূল
জোয়ার-ভাটায় সাগরপারের জেলাগুলোর নদ-নদী ও নিম্নাঞ্চল পানিতে একবার ডোবে, একবার ভাসে। এটাই এখানকার প্রাকৃতিক নিয়ম। তবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো বর্তমানে কেবল মরণনেশা ইয়াবার জোয়ারেই ডুবছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা জেলা বরগুনা ও পটুয়াখালীসহ আশপাশ জেলায় ভয়াবহ রূপ নিয়ে ইয়াবার কারবার। সাগর ও নদীপথে মাছ ধরার ট্রলারে সহজভাবে ও প্রায় নির্বিঘ্নে আসছে ইয়াবার ছোট-বড় চালান। বরগুনার পাথরঘাটা, তালতলী ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া, কুয়াকাটা ও গলাচিপাসহ কয়েকটি পয়েন্ট এখন মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। স্থানীয় একশ্রেণির পুলিশ সদস্য ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পরোক্ষ মদদে উপকূলীয় এসব এলাকায় মাদকের কারবার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে ওইসব জেলার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মাদক তথা ইয়াবার কারবারে উপকূলীয় জেলাগুলো রুট বা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যাপক লাভজনক এই অবৈধ কারবার এসব এলাকায় সহজবোধ্য হওয়ায় উঠতি বয়সি যুবক থেকে শুরু করে সমাজের বড় একটি অংশ মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসায় শেল্টার দিয়ে যাচ্ছেন। আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে মাদকের কারবার নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে নয়ন বন্ডদের মতো কিশোর গ্যাং বা উঠতি সন্ত্রাসী বাহিনী।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে জানান, ‘উপকূলীয় এলাকায় কোনো ইয়াবার রুট নেই। মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অপকর্ম চালিয়ে থাকে। তবে মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরগুনা শহরের অনেক মাদক কারবারি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সরাসরি রাজনৈতিক দলের কমিটির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তাঁতী লীগ ও শ্রমিক লীগের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রয়োজনমতো তারা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। এমনকি বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের একজন শীর্ষ নেতাও বরগুনার বিভিন্ন এলাকার মাদক নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছাত্রলীগের উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের একশ্রেণির নেতাও মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত। ফলে স্থানীয় পুলিশ তেমন পদক্ষেপও নিতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরগুনার বিভিন্ন পয়েন্টে মাদক বিক্রি হয়ে থাকে। শহর থেকে গ্রামগঞ্জÑ সবখানে এখন মাদকে সয়লাব। তালতলী উপজেলার ফকিরহাট রুট, শুভসন্ধ্যা, নিদ্রা, বরগুনা সদরের বালিয়াতলী, নিশানবাড়িয়া, গোড়াপদ্মা, ছুনবুনিয়া, সোনাতলা, নলী, পাথরঘাটার বিএফডিসি, পদ্মা, রুহিতা ও জিনতলাসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে এখন মাদকের চালান আসে। সমুদ্রপথে মৎস্য ট্রলারে করে মাদকের বড় বড় চালান আসে। চারদিকে নদী থাকায় যেকোনো পয়েন্টে ট্রলার থামিয়ে চোরাকারবারিরা মাদকের চালান খালাস করে। এ ছাড়া সমুদ্র উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর প্রধান মাদকের রুট হিসেবে এখন চিহ্নিত কলাপাড়া ও কুয়াকাটা। দ্বিতীয় রুট হচ্ছে গলাচিপার উপজেলার রাঙ্গাবাড়ী। বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে এসব এলাকা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ট্রলারে আসে ইয়াবার চালান। গত বছর কুয়াকাটা রুটেই সাগরপথে আসা প্রায় ৫ লাখ ইয়াবার একটি বিরাট চালান আটক করেছিল কোস্ট গার্ড।
এ সময় একটি ট্রলারও জব্দ করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, কোনোমতে জল থেকে স্থলে উঠিয়ে নিতে পারলেই নানা ধরনের যানবাহন ও শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ কৌশলে পাচার হয় ইয়াবা। পটুয়াখালীর এসব এলাকায় মাদক কারবারিদের মধ্যে মহিপুরের বাবুল মৃধা, তার স্ত্রী হাসিনা বেগম, কলাপাড়ার আবু জাফর ও পলাশ মোড়লসহ আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এলাকাভিত্তিক ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানা গেছে। বরগুনা শহরের ক্রোক এলাকায় মাদকের বড় একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে ফয়সাল ওরফে দুবাই ফয়সাল। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনা আসার পথে লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে মদ ও ইয়াবাসহ তার চক্রের নয়জনকে পুুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই জামিনে মুক্ত হয় ফয়সাল। অন্যদিকে ২নং গৌরীচন্না ইউনিয়নের খাজুরতলার জেন্নাত আলী খান ওরফে জামাই মনির চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। খাজুরতলা গ্রামে তার আলিশান বাড়ি রয়েছে। বাড়ির সামনে থেকে সরকারি পাকা সড়ক পর্যন্ত সিসি ঢালাই করা। স্থানীয়রা বলেছেন, মাদক ব্যবসা করেই মনির এ রকম আলিশান বাড়ি বানিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানকালে স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বরগুনা শহরের কালিবাড়ী ও নয়াকাটা এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে রাজু খান ও মুন্না নামে দুই গ্যাং লিডার। শহরের খেজুরতলা, মহাসড়ক ও ভূতমারা এলাকার মাদক ব্যবসা মো. রিয়াদ খান, সরল ও রুহুলের নিয়ন্ত্রণে। সদর থানার লাকুরতলা গ্রামের সুমন মুন্সী, তার স্ত্রী ফাতেমাও দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তারা একাধিকবার মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছে। মাদক তথা ইয়াবা কারবারি হিসেবে এলাকায় আরও পরিচিত যারা তাদের মধ্যেÑ নুর হোসেন ইমাম, সোহেল, কদমতলার ওয়াসিম, আমতলাপাড় এলাকার রাফি, ধানসিঁড়ি রোডের দীপু, কালিবাড়ী রোডের মুন্না, ৯নং এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের শসাতলার লাবু মল্লিক, একই ইউনিয়নের বালিয়াতলীর সমুন মিয়া ওরফে নাতি সুমন, ফুলতলাসহ আশপাশের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যেÑ রাকিব, আসাদ, সুমন, খলিল, সজীব, ইমন, জলিল, দুলাল, রিয়াজ, আল আমিন ও হাসিব অন্যতম। সম্প্রতি বরগুনার আমতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুব হোসেনকে আটক করে র্যাব-৮-এর সদস্যরা। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি অনিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ছাত্রলীগকর্মী ইমাম হোসেনও মাদক মামলায় বর্তমানে কারাগারে। এক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইমামের ইয়াবা সেবনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল।
অন্যদিকে পাথরঘাটায় মাদকের অন্যতম প্রধান রুট হিসেবে এখন সাধারণ মানুষের কাছেও পরিচিত। মাদকের বড় কোনো চালান আটক না হলেও বরগুনার পাথরঘাটার জল ও স্থল উভয় পথই মাদক কারবারিরা ব্যবহার করছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও পরিবহনকে বেশি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে চরদুয়ানি ও কালমেঘা ইউনিয়নে মাদকের সরবরাহ অত্যধিক। এর মধ্যে চরদুয়ানি ইউনিয়নের আসাদ ও মঞ্জু এবং পাথরঘাটা পৌর এলাকার ইলিয়াস ও মাহমুদ চিহ্নিত খুচরা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুটিকয়েক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করলেও বড় কারবারিরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যারা ধরা পড়ছে তারা খুচরা বিক্রেতা। তারা নিজেরা সেবন করার পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু ইয়াবা সংগ্রহ করে খুচরা বিক্রি করে এলাকায়, যাতে করে তাদের নিজেদের সেবনের খরচ উঠে আগে। সম্প্রতি পাথরঘাটা পৌরসভার এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। এটা নিয়ে স্থানীয় পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে। ওই কাউন্সিলর পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বলেও জানা গেছে।
বরগুনার পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক ও সিনিয়র সাংবাদিক হাসানুর রহমান ঝন্টু সময়ের আলোকে জানান, বরগুনাসহ উপকূলীয় আশপাশের জেলাগুলোতে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছে। মাদকের আধিপত্য থেকেই এখানে সবচেয়ে অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। কিশোর ও উঠতি বয়সি ছেলেরা অল্প বয়সেই বিপুল টাকার মালিক হওয়ার লোভে জড়িয়ে পড়ছে মাদক কারবারে। এই মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই মূলত গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং বা নয়ন বন্ডদের মতো উঠতি সন্ত্রাসী বাহিনী। এসব বিষয়ে প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই জরুরি।
সুত্রঃ সময়ের আলো