আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পাথরচাপা এখনো পাথরঘাটার পানি

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১০:৫৭ এএম, ২২ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১০:৫৯ এএম, ২২ মার্চ ২০১৮

বিশ্ব পানি দিবসরফিকুল ইসলাম, পাথরঘাটা থেকে
দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে বলেশ্বও আর পূর্বে বিষখালী নদী। সাগর ও নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। ভৌগলিক অবস্থান বলে দিচ্ছে উপজেলার তিন দিকেই পানি। তাই দৃশ্যত সেখানে পানির কোনো অভাব নেই। কিন্তু আছে সুপেয় পানির অভাব। খাবার, রান্না আর গোসলের পানির জন্য কষ্টের শেষ নেই পানির দেশের মানুষের। লবণাক্ততা আর মাটির নিচের পাথুরে স্তরই মিষ্টি পানির সংকটের প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ভূগর্ভস্থ পাথরের পুরু স্তরের কারণে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটির কোথাও গভীর নলকূপ বসানো যাচ্ছে না। বিশুদ্ধ পানি সেখানো এখনো পাথর চাপা। পাথরঘাটা পৌর এলাকার অবস্থাও একই রকম।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এলাকার প্রধান প্রধান নদীর উজানে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, ভাটির নোনা পানির প্রবাহ বৃদ্ধি এবং গভীর নলকূপ স্থাপনে প্রাকৃতিক বাধা এ অঞ্চলে সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। লবণাক্ত পানির কারণে পাথরঘাটার কত মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে নেই। তবে পানি নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পাথরঘাটার এক লাখের বেশি মানুষ দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে এ সংখ্যা পৌঁছায় প্রায় দেড় লাখে।

জানা গেছে, একসময় পাথরঘাটার মানুষের খাবার পানির মূল উৎস ছিল পুকুর বা দিঘি। পচাকোড়ালিয়া গ্রামে এ রকমই একটা পুকুর বহু বছর ধরে মানুষ ব্যবহার করছে। তবে ধীরে ধীরে বড় পুকুরগুলোর পানিতেও লবণাক্ততা বেড়েছে। ভরাট হয়ে গেছে বেশির ভাগ পুকুর। কোনো কোনো পুকুরে শুষ্ক মৌসুমে এখন হাঁটু পানিও থাকে না। পাথরঘাটার চরলাঠিমারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের জন্য পুকুর আছে মাত্র চারটি। ওই এলাকার বাকি পুকুরগুলো চৈত্র মাসে পানিশূন্য হয়ে যায়। ঘুরে দেখা গেছে, ওই গ্রামের চারটি পুকুরেও মাত্র তিন থেকে চার ফুট পানি রয়েছে। সেগুলোর পাশে বসানো ফিল্টার থেকে তাই পানি পাচ্ছে না স্থানীয় লোকজন।

সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলার নিজলাঠিমারা গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষের জন্য ব্যক্তিগত সংরক্ষিত পুকুর আছে মাত্র চারটি। এই চারটি পুকুরে বর্তমানে মাত্র তিন-চার ফুট পানি আছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহীম সাজ্জাল বলেন, ‘মোগো পুহুইরে আডু (হাঁটু) হোমান পানিও নাই, আর কয় দিন পর কী যে অবস্থা অইবে, হেইয়্যা কইতে পারি না।’ রুহিতা গ্রামের বাসিন্দা জাকির মুন্সি বলেন, ‘এলাকার একটা পুহুইরেও পানি নাই, সব শুকাইয়্যা গ্যাছে। গাঙ্গের নোনা পানিতে গোসল ও অন্য কাম-কাইজ করলেও তা খাওন যায় না। দেড় মাইল দূরে বাদুরতলা গ্রামে একটা পুহুইরে ফিল্টার আছে। ১০ টাহা দিয়া এক কলস পানি আনাই। অনেকে তাও পারে না।’

পাথরঘাটা পৌর এলাকায় একমাত্র পানির উৎস উপজেলা পরিষদের সামনের পুকুর। সেখানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকে দীর্ঘ লাইন। পৌর এলাকার বরইতলা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ১৫-২০ টাকা দিয়ে এক কলস পানি পান না তাঁরা। উপজেলার কোড়ালিয়া, পদ্মা, বাদুরতলা, ভাঙনসহ আশপাশের গ্রামের একাধিক পুকুরে পানির ফিল্টার (পিএসএফ) আছে। কিন্তু এখন বেশির ভাগ ফিল্টারই অকেজো পড়ে আছে। যেসব ফিল্টার সচল আছে সেগুলোতে শুকনা মৌসুমে পুকুরের পানি শুকিয়ে ও পচে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

বছরের নভেম্বরে বৃষ্টি শেষ হলে পুনরায় মে মাস শেষে বৃষ্টি হতে প্রায় ৭ মাস এলাকার মানুষ পানির জন্য কষ্ট করে। তখন গোসল ও গবাদি পশুর পানের পানিও থাকেনা। শুকিয়ে যায় সকল ছোট পুকুর বা ডোবা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাশাপাশি পাথরঘাটায় পানি সরবরাহে কাজ করেছে, বিএডিসি, বিভিন্ন এনজিও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সহায়তায় গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, পন্ডস স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ), পানিতে লবনাক্ততা দূরীকরণ প্লান্ট (Desalination Plant) স্থাপন করেছে। পাশাপাশি তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের জন্য জনসাধারনকে উদ্ভুদ করছে। বেসরকারি পর্যায়ে পাথরঘাটায় সংকল্প ট্রাস্ট, সংগ্রাম, শুশিলন, ব্র্যাক, আরডিআরএস, অক্সফ্যাম, টিডিএস, বিএডিসি, এসএসডিপি কাজ করছে।

৭টি ইউনিয়ন একটি পৌরসভা নিয়ে পাথরঘাটা উপজেলায়। উপজেলার উত্তর ভাগের কাকচিড়া ও রায়হানপুর ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন ও পান যোগ্য পানি পাওয়া যায় শত ভাগ। অপর ৬টি অঞ্চলে পান যোগ্য পানি পাওয়া যায় না। পৌরসভাসহ পাথরঘাটা, চরদুয়ানী ও কাঠালতলী ইউনিয়নে ১০ শতাংশ, নাচনাপাড় ৫০ শতাংশ, ও কালমেঘা ইউনিয়নে ৬০ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করে।

উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার চরদুয়ানি, পাথরঘাটা সদর, কাঁঠালতলী ও নাচনাপাড়া ইউনিয়নের কোথাও কোনো গভীর নলকূপ নেই। উপজেলায় ৫৫০ টি অগভীর নলকূপ মধ্যে ৩৫৩টি আছে সচল, ২১০৮ টি গভীর নলকূপের মধ্যে সচল আছে ২০৬২ টি রয়েছে। পিএসএফ ৫৮৯ টির মধ্যে সচল আছে ২১৪ টি। রেইন ওয়াটার হার্বেস্টিং (বৃষ্টির পানি সংরক্ষন ব্যবস্থা) ১৪৭টি চালু আছে। Desalination Plant ০৩ টি। কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে অগভীর নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যায় না এবং গভীর নলকূপ থেকে প্রায়ই লোনা পানি ওঠে।

পাথরঘাটা পৌরসভার সাবেক মেয়র মল্লিক মোহম্মদ আইয়ুব বলেন, পৌর এলাকার ভূগর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকূপ বসানো যাচ্ছে না। তাই ডানিডা সরকারের সহযোগিতায় পৌর এলাকা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে কাকচিড়া ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে মাত্র ৬৫০টি হোল্ডিংয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পৌরসভার প্রায় ৭৫ শতাংশ হোল্ডিংয়ে এখনো পানি সরবরাহ করা যায়নি।(সূত্রঃ কালের কন্ঠ)

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/২২ মার্চ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)