শিশুর নামটা মেহেদীই রাখলেন

কাজী রাকিব
কাজী রাকিব, নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:১১ পিএম, ৫ মে ২০২০

শিশুর নামটা মেহেদীই রাখলেন
শিশুটির নাম প্রত্যয়। রেখেছেন মেহেদী নামের এক সমাজকর্মী। মা-বাবা কেন শিশুটির নাম রাখতে পারলেন না? জানতে চেয়েছিলেন মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ

পাথরঘাটার লোক মেহেদীকে চিত্রকর বলে জানে। হ্যাঁ, বরগুনার পাথরঘাটার মেহেদী। বয়স হবে ৪০।  ব্যানার, সাইনবোর্ড লিখে রুটি-রুজি জোগাড় করেন। আর ভালোবাসেন মানুষের জন্য কিছু করতে। প্রায় ১৫ বছর ধরেই এর জন্য কিছু, ওর জন্য কিছু করে চলেছেন মেহেদী। তবে প্রত্যয়ের বেলায় মেহেদীকে সঙ্গ দিয়েছেন আরো কয়েকজন। তাঁদের কেউ প্রশাসনের, কেউ বিচার বিভাগের, কেউ বা জনপ্রতিনিধি, কেউ বা চিকিৎসক। সাংবাদিকও কেউ কেউ এগিয়ে গিয়েছিলেন। এইটুকু শিশু। বয়স মাস গড়িয়েছে মোটে। তার জন্য এত লোকের প্রয়োজন পড়ল? আসুন পাঠক, গোল হয়ে বসুন। ঘটনাটি খুলে বলা যাক।

প্রত্যয় এলো

প্রত্যয়ের মা পাগল। কিছু উত্তর তো এ কথায়ই মেলে। তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কী? কিন্তু মেহেদীর কথা যে শুনতে হবে। তার জন্য একটু আগে থেকে বলি। সাগরপারের ছোট শহর পাথরঘাটা। অলিগলিতে অনেক মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ ঘোরাফেরা করে। পাথরঘাটায় পাগল আছে ২০ বা ২১ জন। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ৬০-এর মধ্যে। হোটেল-রেস্তোরাঁকর্মীদের দেওয়া খাবার খেয়ে রাস্তার ধারে, বিদ্যালয়ের বারান্দা বা পরিত্যক্ত ভবনে রাত কাবার করেন তাঁরা। এদেরই একজন উজালা রানী পাণ্ডে। দুই বছর ধরে আছেন পাথরঘাটায়। উজালার বয়স ২২ থেকে ২৫-এর মধ্যে হবে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে একসময় বোঝা যায়, গোপালগঞ্জে তাঁর বাড়ি। উজালা কিন্তু মাঝেমধ্যে তেড়েফুঁড়ে ওঠে অথবা শহরের মাঝখানের সড়ক ধরে দেন ভোঁ-দৌড়। মাঝেমধ্যে স্বাভাবিক আচরণও করেন।

গেল বছরের শেষ দিকে শহরবাসী উজালার শারীরিক পরিবর্তন টের পায়। নজর এড়ায়নি মেহেদীরও। কে এই কাজ করল? কোন সে পাষণ্ড? মেহেদীর মনেও এসব প্রশ্ন জেগেছিল। তবে তিনি বুঝেছিলেন, সবার আগে প্রয়োজন উজালার পরিচর্যা ও শুশ্রূষা। মেহেদী তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানলেন সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মার্চের শেষ সপ্তাহে সন্তান প্রসব করবেন উজালা। তখন কি আর কেউ জানত, আসছে মার্চ পুরো পৃথিবী একসঙ্গে কাঁদতে বসবে? করোনার ভয়ে লকডাউন হবে বাংলাদেশও? পাথরঘাটাবাসীও বন্দি হয়ে পড়বে ঘরে। মেহেদী কিন্তু সময়কাল জানার পর থেকেই নিয়ম করে উজালার ওপর চোখ রাখতে থাকল। গর্ভবতী মায়ের যে অনেক কিছুই লাগে। খাবার, ওষুধ, শুশ্রূষা ইত্যাদি। প্রয়োজন পড়ে রক্তচাপ মাপার, সুগার মাপার ইত্যাদি। মেহেদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও উজালার কথা জানালেন। নিতে থাকলেন প্রস্তুতি। একদিন মনে মনে অনাগত মানবশিশুর নামও ঠিক করে ফেললেন—প্রত্যয়।

কে সই করবে?

কারো বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া, টোকাইদের পড়াশোনা করানো, দরিদ্রের চিকিৎসা খরচ বহন করার কাজ মেহেদী আগেও করেছেন। তবে পাগলের শুশ্রূষা দেওয়ার কাজটি তাঁর খুব কঠিন লাগছে। সমাজও ব্যাপারটি সহজে নিচ্ছে না। মেহেদী চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধিকেও উজালার ব্যাপারে অবহিত করেন। এ কাজ একার পক্ষে সহজ নয়, ঝুঁকিও আছে। প্রত্যয় জন্ম নেওয়ার আগে মেহেদী কম করে হলেও ২০ বার উজালাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। আল্ট্রাসনোগ্রামও করিয়েছেন। উজালাকে ম্যাক্সি, ব্লাউজ, ওড়নাও কিনে দিয়েছেন। পাথরঘাটা পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর মুনিরা ইয়াসমিন সহযোগিতা দিয়েছেন বেশি।

প্রসবকাল ঘনিয়ে এলে আইনি জটিলতাও দেখা দেয়। প্রসবব্যথায় কাতরাতে থাকেন উজালা, তবে প্রসব হচ্ছিল না। শেষে মেহেদী ও মুনিরা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিজারিয়ানের সিদ্ধান্ত নেন। এখানেই সংকট ঘনীভূত হলো। অপারেশনের সময় কে বন্ডে সই করবে? অবশেষে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবুল ফাত্তাহ উজালার অভিভাবক হিসেবে বন্ডে স্বাক্ষর করলেন। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই অপারেশন করাতে রাজি হলেন সদ্য অবসরে যাওয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বশিরউদ্দিন। আশঙ্কা ছিল, প্রসূতি যদি অপারেশনের পর ছোটাছুটি করেন! তবে পরিণতি হবে ভয়াবহ।

সহমর্মী প্রশাসন

একটি শিশু আসছে পৃথিবীতে। মানবশিশু। তাকে তো স্বাগত জানাতেই হবে। এ শিশুর অভিভাবক এক অর্থে তো রাষ্ট্রই। অপারেশনের আগে পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, পাথরঘাটা চৌকি আদালতের সিনিয়র বিচারিক আদালতের বিচারক সুব্রত মল্লিক এবং পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিনকে উজালার ব্যাপারটি অবহিত করা হয়। জানানো হয় বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহকেও। জেলা প্রশাসক রাষ্ট্রের পক্ষে সম্মতি দিলেন একটি মানবশিশুর নিরাপদ প্রসবে সব সহযোগিতা প্রদানের।

২২ মার্চ ২০২০

বেসরকারি সৌদিপ্রবাসী হাসপাতালে ছিলেন উজালা। হাসপাতালের মালিক বললেন, শুধু ওষুধ খরচ ছাড়া কিছুই নেবেন না। সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে সিজার সুসম্পন্ন হয়। উজালা রানী পাণ্ডের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে এক বালক শিশু। ঘোষণা হলো ‘প্রত্যয়’ তার নাম। টাকা, শিশুর পোশাক ও ওষুধ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে চলে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, বিচারক সুব্রত মল্লিক, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও কয়েকজন সাংবাদিক। প্রত্যয় এখন নিঃসন্তান এক দম্পতির তত্ত্বাবধানে আছে।

চিত্রকর মেহেদী

মেহেদী স্নাতক পাস। এক কন্যাসন্তানের জনক। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি চিত্রকরের পেশায় আছেন। ছবি আঁকার জন্য তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই। দেখে দেখেই শিখে ফেলেছেন। ছবি আঁকা, ছবি বাঁধাই, সাইনবোর্ড লেখা ও রাবার স্ট্যাম্প তৈরি করেন।

রক্ত দিয়ে নাম

২০০৭ সালে  প্রলয়ংকরী ঝড়ের পরদিন এক প্রসূতির রক্তের প্রয়োজন হলো। মেহেদী গেলেন রক্ত দিতে। সেই শুরু, তারপর প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রত্যয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মেহেদী সংগঠনের সভাপতি। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীসহ যারই রক্ত দরকার মেহেদীরা দিয়ে থাকেন। দূরে গিয়েও রক্ত দেওয়ার অভ্যাস তাঁদের আছে। মোট আট হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছে প্রত্যয়। এর মধ্যে সুরমা বেগম নামের এক দরিদ্র থ্যালাসেমিয়া রোগীকেই দেওয়া হয়েছে ১৩০ ব্যাগ। মেহেদীর পুরো নাম মেহেদী শিকদার। ঈমান আলী সড়কের মৃত আবদুর রশীদ সিকদারের ছেলে তিনি। শহরের সব ভালো কাজে আগেভাগেই তাঁকে পাওয়া যায়। কবরস্থানে ফুলগাছ লাগানোয় তিনি অনেক আনন্দ পান। করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে দোকানের সামনে চিহ্ন এঁকে দেওয়ার কাজ করছেন তিনি। মানসিক ভারসাম্যহীনদের আহারের ব্যবস্থা করাও এই সময়ে তাঁর একটি নিয়মিত কাজ। কারণ এখন হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। শহরের বেওয়ারিশ কুকুরের খাবারের ব্যবস্থা করছেন মেহেদীরা।

পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, মেহেদী একজন স্বল্প আয়ের কিন্তু প্রশস্ত মনের মানুষ।

সুত্র, কালের কণ্ঠ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)