জীবনের শেষ সময় এসে স্বামী,র নামে এমন কলঙ্গকের দাগ দেখতে হবে, বলে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তিনি

Shafiqul
Shafiqul, এসআই খোকন
প্রকাশিত: ১১:১৮ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

‘বড় বেদনার, বড় কষ্টের। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি যিনি এখন রাজাকারের তালিকায়। বিদায়ের বেলায় দেখতে হলো আমার স্বামীর নাম রাজাকারের তালিকায়, তাও  আবার ১ নম্বরে। এখন কবর থেকে তুলে আমার স্বামীর বিচার করতে হবে? 

একান্ত সাক্ষাতকারে বড় আক্ষেপ ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে ৯০ বছরের বৃদ্ধা মোসা. নুরজাহান বেগম পাথরঘাটা নিউজকে এসব কথা বলেন। 

সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবসের দিনে তার মৃত স্বামীকে নিয়ে এসব কথা শুনতে হলো বলে তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী মজিবুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে নামিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে জিয়াউর রহমান তাকে ২০ লাখ টাকার বিনিময় তার দলে (বিএনপি) নেওয়ার জন্য অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাননি তিনি। 

নুরজাহান বেগম বলেন, ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারবাহিনীরা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিন্তু তখন আমার স্বামী মজিবুল হক নিজেই একাধিকবার পাক হানাদারবাহিনীর কাছে বুক পেতে দিয়েছিলেন তারপরেও মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা থেকে বিরত রেখেছিলেন। 

এসময় হায়রে স্বাধীন দেশ বলে আক্ষেপ করেন নুরজাহান বেগম। 

স্বামী মারা গেছে ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এখন আমার যাওয়ার পালা। বিদায়ের ঘণ্টা যখন বাজছে ঠিক তখন স্বামীর নাম রাজাকারের তালিকায় দেখতে হলো। এখন বিচার চাইবো কার কাছে। এখন আল্লাহর কাছেই বিচার চাইছি।  

রোববার (১৫ ডিসেম্বর) মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজিবুল হকের নাম রাজাকারের তালিকায় ১ নম্বরে আসায় গোটা পাথরঘাটার জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন সংগঠক এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের হয়ে নিরলসভাবে কাজ করেছেন তার নাম রাজাকারের তালিকায় এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা পাথরঘাটার মানুষ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. আমির হামজা, মো. খলিলুর রহমান ওরফে মানিক এবং অপর এক আওয়ামী লীগ নেতা মো. আমজাদ হোসেনসহ ৮ জনের নাম রয়েছে। 

এদিকে এই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রাজাকারের তালিকায় ১ নম্বরে পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মজিবুল হকের নাম থাকায় গোটা পাথরঘাটায় তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বইছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠন এবং বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিবাদ বইছে। রাজাকারের তালিকায় মুজিবুল হকের নাম প্রকাশ হওয়ায় তীব্র নিন্দার পাশাপাশি যারা এই তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে তাদের বিচারের দাবি জানান।

পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জাবির হোসেন বলেন, মুজিবুল হকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং পাপাশাশি ১৭ ডিসেম্বর আমরা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবো। 

পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কালমেঘা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং মুজিবুল হকের জামাতা আকন মো. সহিদ বলেন, ৭৫ এর পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়েও দলের হাল ধরেছিলেন মুজিবুল হক, তার নাম রাজাকারের তালিকায় ১ নম্বর এসেছে এটি দুঃখজনক। যারা তার নাম এই তালিকায় দিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ এটির সঠিক তদন্ত করা হোক।

পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মজিবুল হক সাহেব মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন না। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার এক নিকমটতম আত্মীয় পাগলা আজিজ এবং পাকিস্তানি মেজর পারভেজের চাপে জীবন রক্ষার জন্য একবার পটুয়াখালী মেজর পারভেজের কাছে যেতে হয়েছিল। 

তিনি আরও বলেন, এ তালিকায় তার নাম আসায় আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং প্রকৃত যারা রাজাকার তারা খুশি হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। 

মজিবুল হক, বাবার নাম মৃত আবদুল আজিজ। যাকে ভালোবেসে নয়া ভাই বলে ডাকতেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদ পাথরঘাটা শাখার সভাপতি, পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। 

১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (পাথরঘাটা-বামনা) সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। 

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)