ভয়াল সিডরের যুগপূর্তি: অরক্ষিত উপকূল আতংকের জনপদ

রুদ্র রুহান
রুদ্র রুহান, জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৩:১০ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০১৯


ভয়াল সিডরের যুগপূর্তি আজ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। সিডরের মাত্র আধ ঘন্টার তান্ডব লন্ডভন্ড করে দেয় গোটা উপকূল।

এক যুগেও সে ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেখানের মানুষ।এর মধ্যে মরার উপর খারার ঘা হয়ে সম্প্রতি আঘাত হানে আর এক দানবীয় ঝড় বুলবুল।

এর আগেও আইলা, মহাসেন, ফনিসহ বিচিত্র নামের সব ঘূর্ণিঝড়েই কম বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় জেলা বরগুনা। বসত বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, গাছপালা, ফসলের মাঠসহ প্রায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই প্রানহানীর মত ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।

২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর যখন উপকূলে আঘাত হানে তখন মাছ ধরার ট্রলারে ছিলেন ইব্রাহীম। পরে ঝড়ে উল্টে যায় তার ট্রলার। সাগরে ভাসতে থাকেন তিনি। এদিকে আশ্রয় প্রকল্পে যাওয়ার সময় জলোচ্ছ্বাসের কারেণ স্ত্রী জেসমিনের কোল থেকে ছিটকে পড়ে চিরতরে হারিয়ে যায় তাদের একমাত্র ছেলে। সর্বশেষ ৫ মে ২০১৯, শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ঘরের নীচে চাপা পড়ে নিহত হন তার মা নূরজাহান বেগম এবং ছোট ছেলে জাহিদুল। তিন তিনজন স্বজন হারানো ইব্রাহীম নিজেই শুধু রয়েছেন এখন। দেখেছেন ঝড়ের ভয়াল তান্ডব।

সিডরে ছেলে হারানোর পর কেন তবে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেননি ইব্রাহিম? প্রশ্ন ছিল তার কাছে। হাউমাউ করে কাঁদেন কিছুক্ষণ, ‘মুই বোজদে পারিনায় যে বইন্যাডা এত জোরে আইবে’ বইন্যার ভাও (হাবভাব) বুইজ্জা আশ্রয় কেন্দ্রে যাইতে চাইছিলাম, এর মইদ্যে আচুক্কা (হঠাত) গাছটা ভাইঙ্গা ঘরে পইর্যা  মোর মায় আর পোলাডায় মইর্যা্ গেলো’।

ইব্রাহিমের কাছাকাছি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। তবুও সময়মত আশ্রয় কেন্দ্রে না যাওয়ায় এ দূর্ঘটনার শিকার হন তিনি। উপকূলীয় দূর্যোগ বিশ্লেষক ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দীন বলেন, সিডরে প্রানহানির যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এর প্রায় সবই এই ইব্রাহীমের মত যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে না যাওয়ায়। অপেক্ষা করে অবশেষে যখন মানুষ অনিরাপদ হয়ে পড়েন তখন ছুটোছুটি করতে গিয়ে বানের তোড়ে ভেসে বা গাছ চাপায় এসব মানুষের মৃত্যু হয়।   

মূলত, দূর্যোগকালীন সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে না যাওয়ার ব্যাপারে এখনো তাঁদের আমরা সচেতন করে গড়ে তুলতে পারিনি। পাশাপাশি দূর্যোগ সহনশীলতার মানসিকতা, অর্থাৎ, যা হয় হোক, ঘরেই থাকবো এমন মানুষিকতার কারণেই এরকম ঘটনা। এ ব্যাপারে আরো কাজ বাকি রয়েছে বলেই আমি মনে করি। আমাদের প্রথমে প্রয়োজন সুরক্ষার স্বার্থে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের সচেতন করে তোলা।  

সিডরের এমন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যথাসাধ্য উদ্যোগ গ্রহন করে। পাশাপাশি দেশী ও বিদেশী দাতা সংস্থাও এগিয়ে আসে। একের পর এক উন্নয়ণ পরিকল্পনায় ফের যখনই ঘুরে দাড়ানোয় মানুষের প্রানান্ত প্রচেষ্টা, ঠিক তখনি কোনো না কোনো দূর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয়। চলে নিয়ন্ত্রহীন দানবীয় ঘূর্ণিঝড়ের একের পর এক তান্ডবলীলা। আর এসব মোকাবেলা করতে এখন অনেকটাই অভ্যস্ত এলাকার মানুষ। ফের সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয় ক্ষত কাটিয়ে ওঠার। সিডরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ২৯ জনের মৃত্যু হয়। একের পর এক মরদেহ উদ্ধারের পরে তাদের এক স্থানে দাফন দেয়া হয়। সাড়িসাড়ি সেই কবরের স্থানটিতে এ বছর নির্মিত হয়েছে সিডর স্মৃতিসৌধ।     

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, সিডরের আঘাতে জেলার সাড়ে ৯শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর পরবর্তি আইলা, মহাসেন, ফণীসহ একাধিক প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পায়রা বলেশ্বর ও বিষখালী নদী তীরবর্তি বন্যা নিয়ন্তন বাঁধগুলো নাজুক হয়ে পড়ে। বাঁধের কিয়দংশ সংষ্কার ও রিং বেরীবাধ দিয়ে আপাতত জানমাল রক্ষা হলেও ফের বুলবুলের আঘাতে জেলার ৩৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিঁপূর্ণ অবস্থায়। স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই ওইসব এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে নিমজ্জিত হয় বসত-ভিটা, লোকালয় ও ফসলী জমি। চরম শংকায় দিন কাটে বাঁধের পাড়ের বাসিন্দাদের, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। স্থানীয়দের দাবি, নদী শাসন করে স্থায়ী সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণই একমাত্র কার্যকরি সমাধান, এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষা সম্ভব না। তাদের অভিযোগ, মানুষের জানমাল রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষের মনোভাব অনেকটাই দায়সারা। রিং বাঁধ নির্মাণ করে আপাতত দায় এড়িয়ে যান তারা।

কথা হয় ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ কয়েকজনের সাথে। শাহনেওয়াজ সেলিম নামের একজন বাসিন্দা বলেন, সিডরে সবেচেয়ে ক্ষতি নলটোনা ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এর অন্যতম কারণ ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ। এই বাঁধ ভেঙে ও প্লাবিত হয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। আর মধ্যরাতে পানির তোড়ে ভীত মানুষজন ছোটাছুটি করতে গিয়ে গাছ চাপাও প্রবল স্রোতে ভেসে মারা যায়। ১২ বছর পরেও চিত্রটি অভিন্ন নয়, সেলিম বলেন। এখানের এখনো ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকার বাঁধের এক তৃতীয়াংশ টিকে আছে। তিন তিনবার রিং বাঁধ দেয়া হয়েছে, কিন্ত একটিও টিকে নেই, না থাকারই কথা। কারণ নদী শাসন করে বøক দিয়ে স্থায়ী সুরক্ষা ব্যতীত উপকূলীয় এলাকাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের রক্ষার সুযোগ নেই।

এলাকার চেয়ারম্যান মোঃ গোলাম কবীর বলেন, আমার ইউনিয়ন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এলাকার মানুষের বিপদের অপর বিষখালী নদী। নলটোনা ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের দুই তৃতীয়াংশই ঝুঁকিতে। আমরা অনেক চেষ্টা তদবির করেও ব্যর্থ হয়েছি। কোনো উপায় নেই এখন আর আমাদের।

বরগুনা সদরসহ পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী, তালতলী ও আমতলী উপজেলার বিষখালী বলেশ্বর ও পায়রা নদী তীরবর্তি ঝূঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকার বাসিন্দাদের একই অবস্তা। দূর্যোগের ঘনঘটনায় এদের যেমন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটে তেমনি অরক্ষিত থাকেন বছরজুড়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সংষ্কারের আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছি। আশা করি দ্রুত এসব বাঁধ নির্মাণ ও সংষ্কারে উদ্যোগ নেবে সরকার।

৩ নভেম্বর বরগুনা পরিদর্শণকালে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রি জাহিদ ফারুক সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, পর্যায়ক্রমে সব বন্য নিয়ন্ত্রন বাঁধ স্থায়ী সুরক্ষার আওতায় এনে সংষ্কার করা হবে।  

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)