পাথরঘাটায় “কল্লাকাটা” আতঙ্ক বাড়ছেই, উৎকন্ঠায় অভিভাবকরা

‘কল্লা কাটা’ নিয়ে মানুষের কৌতূহল যেন কিছুতেই কমছেনা। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এ গুজব। এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও ছড়িয়েছে এটি। দেশের অন্যতম বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন একটি গুজবটি শুধু শহরে নয় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে, যার প্রভাবে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে অনেক শিশু। সাথে সাথে স্কুল গুলোতে ও অভিভাবকদের উপস্থিতি ও উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা গেছে।
দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনার পাথরঘাটার বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে জানা যায় নেত্রকোনার পৌর এলাকায় ব্যাগের ভিতরে শিশু সজিবে মাথা পাওয়া, গতকাল বুধবার সকালে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে মাদ্রাসা ছাত্র আবির হুসাইনের কল্লা কাটা লাশ উদ্ধার করা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘কল্লাকাটা’ বিচ্ছিন্ন দেহ উদ্ধারের পাশাপাশি কল্লা কাটা ধরে গনপিটুনিতে হত্যার ব্যাপারগুলো কোন অভিভাকরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে চায় না।
‘কল্লা কাটা’ আতঙ্ক এখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরেও গিয়ে পৌঁছেছে। নিজের শিশু সন্তান হারিয়ে যাওয়ার ভয় এখন মানুষের মধ্যে জেঁকে বসেছে। কোন কিছুতেই তারা বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না যে এটা একেবারেই একটা গুজব।
পাথরঘাটা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল আহসান জানান, বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপরিচিত কাউকে দেখলেই অভিভাকরা আতংকিত হয়ে যায়। তিনি জানান বেশ কয়েকদিন ধরেই সারাদেশে গুজব ছড়িছে পড়েছে যে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন। আর সে গুজব থেকেই অভিভাবকের মনে এই প্রবল সন্দেহ বলে জানান ওই শিক্ষক।
এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত গহরপুর সাইদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আফরোজা মনি বলেন ‘কল্লা কাটা’ গুজব গ্রামাঞ্চলে এতোটাই ছড়িয়েছে যে বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি পর্যন্ত কমে গেছে।
পাথরঘাটা তাসলিমা মেমোরিয়াল একাডেমীর নার্চারি ক্লাসের শিক্ষার্থী নিসা মনি’র মা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘কল্লা কাটা’র কথা তো এখন সব জায়গায় ছড়াছড়ি চলে। বাচ্চারা একটু ভয় পায়। স্কুলে একা আসতে চায় না।
হাফিজা বেগম নামে আরেক অভিভাবক বলেন, এখন বাচ্চাদের সাথে স্কুলে যাওয়া লাগে এবং বাচ্চাদের স্কুল থেকে যাইয়্যা আনা লাগে। আমরা খুব আতঙ্কের ভিতরে আছি।
একটি কুচক্রী মহল এমন মারাত্মক গুজবও ছড়িয়েছে যে প্রতিটি স্কুল থেকে একটি করে শিশুর মাথা চাওয়া হয়েছে মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলে স্কুলে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাচ্চাদের অভিভাকরা একে অপরকে বলতেও শোনা গেছে যারা এই ‘কল্লা কাটা’র সাথে জড়িত তাদের গায়ে একটি সিল মারা আছে যা দেখলে পুলিশ তাদেরকে সহযোগিতা করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ গুজবগুলো বেশি ছড়িয়ে পড়ছে স্কুলে আসা শিশুদের মায়েদের কাছ থেকে। তারা একে অপরকে এসব জানান দিচ্ছে আর আগ্রহের সাথে গনমাধ্যমে আসা ‘কল্লাকাটা’র সংবাদগুলো উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি ডেমরায় শিশু তুবার মাকে সন্দেহের বসে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় ও মর্মাহত তারা। তবে স্কুলে স্কুলে চিঠি দিয়েছে এই বিষয়ের কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সগির হোসেন।
এ ব্যাপারে পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ হানিফ সিকদার আমাদের সময়কে বলেন, দেশে গুজবের মধ্যেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের কাছে অনুসন্ধানের বিষয়টি জানালে তিনি এ ব্যাপারে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিয়ে কাউন্সিলিং করবেন বলে জানিয়েছেন।
পাথরঘাটা উপজেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি এইচএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ‘কল্লাকাটা’ এমন একটি গুজব ছড়িয়ে সমাজে উত্তেজনা বিরাজ করছে যা সামাল দিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এজন্য সকল পেশার মানুষকে সচেতন হতে হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এসব গুজবের কোনো স্থান নেই বলে জানান পাথরঘাটা সিদ্দিকিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রভাষক হাফেজ মাওলানা গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, যে কোনো কাজের শুরুতে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে করতে হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজেও এমনটি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দোয়া মোনাজাতের মধ্যদিয়ে এই সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। যারা কাটা মাথা দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের সমাপ্তির গুজব ছড়িয়ে তারা কুফরিতে পরিনত হয়েছে। তাদেরকে তওবা করারও আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে এটা একটি গুজব। একটি কুচক্রী মহল সেতুতে মাথা লাগার এ গুজব ছড়িয়েছে। এই গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যও কর্তৃপক্ষ সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন।