‘মোর ছেলের পেছনে তো গাইড নাই, তাইলে ক্যামনে বন্ড হইলে?’ - নয়ন বন্ডের মা
‘মোর ছেলের পেছনে তো গাইড নাই, তাইলে ক্যামনে বন্ড হইলে? এতো কিছু অইলে ক্যামনে? এর পেছনে কারা আছে হেইডা আপনারা (সাংবাদিক) তদন্ত করেন। পেছনে কারা আছে না বাইর কইরা মোর ছেলেডারে ক্যান মাইরা ফালাইলে? এইডা কাগো ষড়যন্ত্র হেইডা তদন্ত করেন। আমার মনডা চায় ঢাহায় গিয়া পোরধানমন্ত্রীর কাছে কই…।’ বিলাপ করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন শাহিদা বেগম। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের মা তিনি।
গত রবিবার বরগুনা শহরের পশ্চিম কলেজ রোডের বাসায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় শাহিদা বেগম নিজের ছেলের মাদক কারবার ও গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়া, রিফাত খুন ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারানোর জন্য প্রভাবশালী মহলকে দায়ী করেছেন।
গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে ভাইরাল হলে সারা দেশে আলোচনা শুরু হয়। এ ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি নয়ন ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এ নিয়ে বরগুনার বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। তারা বলছিল, নয়ন বন্ড নিহত হওয়ায় তার আশ্রয়দাতারা আড়াল হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। বেশ কিছুদিন পর পুলিশের হাত ঘুরে গণমাধ্যমে নতুন আরেকটি ভিডিও ফুটেজ আসে। গণমাধ্যমে সেটি প্রকাশের পর নয়নের মা শাহিদা বেগম প্রকাশ্যে আসেন। তিনি নতুন ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে মিন্নিকে জড়িয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এরই ধারাবাহিকতায় মিন্নির শ্বশুর তাঁর ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। একই দাবিতে ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ বক্তব্য দেন। এরপর ঘটনা নতুন দিকে মোড় নেয়।
রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড নিয়ে শাহিদা দাবি করেন, ‘মিন্নি জড়িত থাকলেও এর পেছনে আরো কিছু আছে। তা নাইলে আমার পোলাডা ক্যান মারতে গেলো? সব বাইর না কইরা ওরেই ক্যান মারল? মিন্নি যহন রিফাতরে বিয়া করছে তখন তো মারে নাই। কোনো ঝামেলাই তো দেখি নাই।’
রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর নয়নের মাদক কারবারে জড়িত থাকা এবং তাকে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বিষয়গুলো উঠে আসে। যদিও পুলিশ এখন পর্যন্ত দাবি করে আসছে, ব্যক্তিগত কারণে রিফাত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এতে মাদকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
শাহিদা বেগম জানান, নয়নের বাবা আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। ছোটবেলায় লেখাপড়ায় ভালো ছিল সে। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছিল। মাধ্যমিকে পড়ার সময় মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে নয়ন। এরপর জড়িয়ে পড়ে গ্যাংয়ে। নয়নের বড় ভাই মিরাজ সিঙ্গাপুরে থাকেন। অপরাধজগতে জড়ানোর কারণে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তিনি চার বছর ধরে কথা বলতেন না।
শাহিদা বলেন, ‘ওরে বাবা (বিলাপ করে), বড় ছেলেডার একটা মাইয়া হইছে। আমি কইছি, নয়ন মাইয়াডার দিকে চাইয়া সব ছাইরা দাও। নাইলে লোকজন তোমার ভাতিজিরে কইবে। বলছে, আম্মু ছাইড়া দিবো। কী হইলে, কী ছাড়লে…।’
রিফাত হত্যার ঘটনা কেন ঘটল জানেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে শাহিদা বেগম বলেন, ‘কারা এই ঘটনার পেছনে হেই মূল রহস্যডা আমি এহনো বুঝতে পারছি না। আমার ছেলেডা যদি বাইচা থাকতে, তাইলে মূল রহস্যডা বলা যাইতে। তারপর আইনে যে বিচার হইতে মাইনা নিতাম। তার বিচার কারা করলে আমি কিছুই বুঝতাছি না। আমার নয়ন বইলা যাইতে, এর পেছনে আরো কিছু লোক মনে হয় আছে। আমার এইয়া সন্দেহ হয়। এর কোথায় কী পরিকল্পনা তা পাইতাছি না। এর ভেতরে আরো কিছু লুকাইন্না আছে। এতো পোলাপাইন ক্যান আইলে। এক গুলিতে দুইডা পাখি মাইরা ফালাইছে। রিফাতরে যে কোপ দিলে, মারা না গেলেও ওর (নয়ন) দুই বছরের সাজাও তো হইতে। এগো (হামলাকারীদের) বড় ধরনের কিছু (লোভ) দেখাইছে।’ তিনি যোগ করে বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনে (রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ ও স্থানীয় প্রভাবশালী) বলা হইছে ওরে (নয়ন) কয়েকবার পুলিশে ধরাইয়া দেওয়া হইছে। আবার হুনি তাগো লগেই আছিলে। রাজনীতির খেলা, অ তোমরা বুঝবা কিছু? ও যে দল গঠন করে, তাও আমি বুঝিনি। দেখি নাম দিছে নয়ন বন্ড। হে কি এক দিনে নয়ন বন্ড হইছে? কারা বানাইছে? প্রভাবশালীরা তারে ব্যবহার করতে নয়ন বন্ড হিসাবে তৈরি করছে। আর হেই প্রভাবশালীরা নিজেরা বাচতেই নয়নরে শেষ করছে। কে হ্যারে বন্ড বানাইলে, জিরো জিরো সেভেন বানাইলে, তোমরা (সাংবাদিক) খুঁইজা বের করো। এর আগে নয়ন ১২ লাখ টাকাসহ ধরা পড়ছিল। সে এত টাকা কোথায় পাইলে? কে দিলে? তোমরা খুঁইজা বাইর করো।’
প্রভাবশালী মহল কারা, কারা এর পেছনে—জানতে চাইলে নয়নের মা বলেন, ‘জিরো জিরো সেভেন আর বন্ডের পেছনে এক নেতার ছেলের নাম শুনি। আমি বলবো না। আমার একটাই অনুরোধ, আমার ছেলের পেছনে কারা, তদন্ত করো।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতাসহ অনেকে অভিযোগ করেছেন, নয়নসহ অপরাধীদের মদদদাতা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সুনাম দেবনাথ। তিনি মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও অভিযোগ ওঠে। তবে বরাবরই সুনাম দেবনাথ এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
রিফাত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং এরপর রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা, সঙ্গে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ পুরো ঘটনাকে ভিন্ন এক মাত্রা দেয়। অভিযোগ ওঠে যে বড় কিছু আড়াল করতেই পেছন থেকে শম্ভু পরিবার কলকাঠি নাড়ছে।
নয়নকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে শাহিদা বেগম বলেন, “আমি টিভির হেডলাইনে পাথরঘাটা বইসা দেখছি, কেউ একজন কইছে, আমার ছেলে সীমান্তের কাছে আছে। সেই ছেলে তিন দিন পর আইসা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায় কিভাবে? তার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তার হাতের নক ও কান নাই। ওরা আমার বাবারে (নয়ন) মাইরা হালাইছে।’
শাহিদা বেগম বলেন, ‘বিয়া নিয়া যদি টার্গেট থাকতো, আগেই কোপাকুপি হইতে। এইডা তো হয় নাই। ক্যামনে যে হইলে জানি না।’ (তথ্য সূত্রঃ কালের কন্ঠ)