নয়ন বন্ড বনাম সামাজিক নিরাপত্তা

Shafiqul
Shafiqul, এসআই খোকন
প্রকাশিত: ০৩:২১ পিএম, ৬ জুলাই ২০১৯

নয়ন বন্ড বনাম সামাজিক নিরাপত্তা / ছবিঃ সংগ্রহীতশব্দটি এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বে পরিচিত একটি শব্দ। যদিও এর আগে ০০৭-এর বিষয় অনেকেই অবগত ছিলেন। জেমস বন্ড বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ইযান ফ্লেমিং সৃষ্ট উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র বিশেষ। ১৯৫৩ সালে রচিত এ উপন্যাসে জেমস বন্ড রয়েল নেভি কমান্ডার হিসেবে রয়েছেন। জেমস বন্ড নিয়ে সিরিজ আকারে নির্মিত অসংখ্য উপন্যাস, চলচ্চিত্র, কমিকস এবং ভিডিও গেমের প্রধান চরিত্রে রয়েছেন জেমস বন্ড। লন্ডনের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের প্রধান গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের নাম পরিবর্তিত হয়ে এমআই-৬ নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশে জেমস বন্ড নেই, তবে একজন নয়ন বন্ড তৈরি হয়েছিল। যার সূর্য উদিত হলেও আলো ছড়াতে পারেনি। তিনি নিজেই এই উপাধি নিয়েছেন। তার শক্তির উৎস মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি। নয়ন বাহিনী তার নিজের নামের সঙ্গে কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে ০০৭ আর নয়ন বন্ড লাগিয়েছেন। ০০৭ সাংকেতিক নম্বরটি জেমস বন্ড নয়ন বন্ড ধারণ করেছেন। জেমস বন্ডের মতোই ব্যতিক্রম হিসেবে নয়ন বন্ডও ডাবল-জিরো শব্দটির মাধ্যমে রিফাতকে হত্যা করার সব পরিকল্পনা করেন ০০৭ গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে। রিফাত হত্যা নিয়ে কয়েক দিন ধরে গোটা দেশে আলোচিত চাঞ্চল্যকর ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যখন পর্যায়ক্রমে রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকরা ধরা পড়ছে, তখন সারা দেশের মানুষের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল নয়ন বন্ড কি আদৌ আটক হবে? এরপরও জনগণের বিশ্বাসও ছিল এত বড় অপরাধ করে নয়ন বন্ড এড়িয়ে থাকতে পারবে না। বন্দুকযুদ্ধেই মারা যাবে। মানুষের ধারণা ঠিক তাই হলো। মঙ্গলবার ভোর হতে না হতেই শোনা গেল নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।

যদি প্রশ্ন করি, আমরা এক দিন মানুষ ছিলাম, এখন আমরা মানুষ নেই। মানুষের মনুষ্যত্ব না থাকলে তাকে কি মানুষ বলা যায়! এখন আমরা অমানুষ হয়েছি? যেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে রামদা দিয়ে জীবন্ত মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যে দেশে মা ও মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যেখানে ৯ বছরের কন্যাসন্তানকে মা গলাটিপে হত্যা করে, যেখানে চলন্ত বাসে নারীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে, সেখানে এমন প্রশ্ন জাগাটাই অস্বাভাবিক নয়। স্ত্রীর সামনে একটি জীবন্ত প্রাণকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা সেই ঘাতকদের পশু ছাড়া আর কিইবা বলা যায়? পশুদের প্রাণ আছে, কিন্তু বোধ বুদ্ধি নেই, তাই তারা হিংস্র জানোয়ার। আমাদের প্রাণ আছে, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন, তাই আমরা মানুষ। মনুষ্যত্ব বোধ আছে বলেই আমরা মানুষ। কিন্তু আমাদের আচার-আচরণ, সামগ্রিক চিন্তাচেতনা ভাবনায় আমরা কি সত্যি মানুষ? এ প্রশ্ন আজ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। মানবতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়েছে? এ জঘন্য কার্যটির ভিডিও ছবি ভাইরাল হয়েছে। এ জঘন্য বর্বরোচিত আক্রমণ যখন নিরপরাধ নিরস্ত্র রিফাতের ওপর চলছিল, তখন পাশেই অনেক পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা নপুংসক কি না জানি না। তবে নির্বোধ আবেগ অনুভূতিহীন সমাজের চরম স্বার্থপর বাসিন্দা তারা।

‘রিফাত হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ‘০০৭’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ করেছে। ইতোমধ্যেই এ গ্রুপে রিফাত হত্যার পরিকল্পনার কথোপকথনের বেশ কয়েকটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ‘০০৭’-এর কথোপকথনের বিষয়টি ঘেঁটে দেখা যায়, রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের দিন বুধবার সকাল ৮টা ৬ মিনিটের সময় রিফাত হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী গ্রুপে লেখেন, ‘০০৭-এর সবাইরে কলেজে দেখতে চাই।’ এর উত্তরে মোহাম্মাদ নামে একজন লিখেন, ‘কয়টায়’। নয়ন ফরাজী লেখেন, ‘০০৭-এর সবাইরে কলেজে দেখতে চাই।’ এর উত্তরে বরগুনায় কনস্টেবল পদে পুলিশের চাকরি পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ সাগর সম্মতিজ্ঞাপনসূচক এবং বিজয়ের প্রতীক ভি (া) সিম্বল দিয়ে উত্তর দেন। এরপর মাহমুদ আবার রিফাত ফরাজীকে লেখেন, ‘কয়টায় ভাই।’ এরপর রিফাত ফরাজী উত্তর দেন, ‘৯টার দিকে।’

তথ্যপ্রযুক্তির দেশে প্রতিনয়তই যে ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশ ঘটনাই ভিডিও হয় এবং সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। বরগুনার রিফাত হত্যার পর আবারও আলোচনায় একটি প্রশ্ন। প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ ঘটনার ভিডিও ধারণ করলেও আক্রান্তকে রক্ষায় এগিয়ে যায়নি কেউ। একইভাবে ২০১৬ সালে সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কোপানো হয় প্রকাশ্যে। একইভাবে বিশ্বজিৎকে পুরোনো ঢাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ব্লগার অভিজিৎ রায়কেও প্রকাশ্যে কোপানো হয়। প্রকাশ্যেই কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয় লেখক হুমায়ূন আজাদকে। এসব ঘটনাতে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে ছবি তুললেও কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে যাননি। অনেকেই এই ভিডিও ধারণের বিরোধিতা করেছেন। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাটি ঘটনার সময় ভিডিও করার আগে বিশ্বজিত এবং রিফাতকে রক্ষা করা উচিত ছিল; এটি যেমন সত্য একইভাবে যারা ভিডিও করেছেন তারা রামদা বা চাপাতির সামনে প্রতিরোধে যে দাঁড়াবেন না বা দাঁড়াতে পারেন না, ইহাও সমভাবে সত্য এবং ভিডিও করার কারণেই ঘাতক বা অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে সাংবাদিকরা একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে ভিডিও করছেন, এ রকমের অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশে রয়েছে।

বরগুনার নয়ন বাহিনীর এই ০০৭ দলের সদস্যরা সকলেই কিশোর। কিংবা মাত্র তারুণ্যের চৌকাঠে পা রেখেছে। ০০৭ নামে একটি গোপন গ্রুপ তৈরি করে নয়ন ফেসবুক মেসেঞ্জারে রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা প্রকাশ করে। সুতরাং এ গ্রুপের ভয়াবহতা বিবেচনায় আনতে হবে। পাশাপাশি কেউ যেন ছাড় না পায়, সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে প্রশাসনকেই। আর আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার ন্যায়বিচার নিশ্চিতে হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়াও জরুরি। সাম্প্রতিক সময় একটি বিষয় চোখের পড়ার মতো। সেটি হলো, যেকোনো বিষয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দেখতে হয়। দেশের ছোটখাটো সব ঘটনা, দুর্ঘটনার জন্যই যদি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মাথা ঘামাতে হয়, তা হলে দেশজুড়ে এত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পাশাপাশি সুশীল সমাজের লোকজনইবা আছেন কী জন্য? তাদের কাজটাইবা কী? খাদ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তাকে বদলি, বিদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বদলি বাতিল, শিশু ভ্যানচালক শাহিনের চিকিৎসার ভার প্রধানমন্ত্রীর নিতে হচ্ছে, নয়ন বন্ডের মতো জঘন্য অপরাধকে ধরতেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দিতে হয়, সিলেটে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা, শিক্ষিত বেকার প্রতিবন্ধী নারী চাঁদের কনার চাকরিÑ সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীর দেখতে হয়; তা হলে এত দফতর, এত মন্ত্রী ও এমপিরা কী করছেন?

০০৭ নয়ন বন্ডের মতো কি বাকিদের বিচার হবে?, না আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসবে? এ রোমহর্ষক খুনের ঘটনায় অপরাধীরা কি আদৌ শাস্তি পাবে? নয়ন নিহত হওয়ার পর জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত প্রথা রয়েছে, সেটি হচ্ছে দোষীরা অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে আসেন। দেশের আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে আসামিরাও জামিন পাওয়ার হকদার; কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা থাকে যা আদালতের প্রথা অনুযায়ী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে শুরুতে তা নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়ে যায়। সবকিছু দেখে মনে হয়, এই বুঝি সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। কিন্তু হইচই বেশি দিন থাকে না। নতুন কোনো ঘটনা ঘটলেই আগের ঘটনা আড়ালে পড়ে যায়। রিফাতের কথাই যদি ধরি, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ঘটনাটি অনেকটাই আড়াল হতে চলেছে। অথচ এই ঘটনাকে মোটেই আড়াল হতে দেওয়া উচিত নয়। বরং এ ঘটনার সূত্র ধরে গোটা দেশে সন্ত্রাস ও অনাচারের বিরুদ্ধে একটা জাগরণ তৈরি করা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, রিফাত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পেলে গোটা দেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারণ অপরাধের বিচার না হলে অপরাধী সাহসী হয়ে ওঠে। কাজেই অপরাধের বিচার হওয়া জরুরি।

নয়ন বন্ডের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরপরই অনেকে মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে বলবেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, এটি ঠিক হয়নি, এটি আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, মানুষের জন্যই মানবাধিকার। নয়ন যখন প্রকাশা দিবালোকে একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল; তখন মানবাধিকার ছিল কোথায়? নয়ন ও তার সহযোগীরা আর মানব নয়। ফলে তাদের জন্য মানবাধিকারও প্রযোজ্য নয়। এরা সমাজের আগাছা। যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নয়ন বন্ডের মতো তরুণ জন্ম হবে। নয়ন বন্ডের মতো তরুণরা দেশের আগাছা হবে, কারো দ্বারা ব্যবহৃত হবে? রাজনীতিকরাই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। তাদেরকেই বলতে হবে, তারা আর নয়ন বন্ডের মতো সন্তাসীদের আশ্রয়দাতা হবেন না। নিজ স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করবেন না। তা হলেই হয়তো দেশ থেকে নয়ন বন্ডের মতো সন্ত্রাসীদের বংশবৃদ্ধি কিছুটা হলেও রহিত হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
msi.khokonp@gmail.com

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)