নয়নের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার নেপথ্যে
বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার দুই দিন আগে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সুনাম দেবনাথকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আনা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে নয়নকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। এমপিপুত্রকে ডেকে আনার সঙ্গে নয়নের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও পুলিশ কিংবা এমপিপুত্র ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করেছেন।
অন্যদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের বাসায় যে রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েছিল, ঠিক সে রাতেই তাঁর ভায়রার ছেলে একই মামলার আসামি রিফাত গ্রেপ্তার হয়েছিল। রিফাতকে কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তা জানাতে চায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, রিফাতকে চেয়ারম্যানের বাসা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নয়ন নিহত হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন স্বস্তি প্রকাশ করেছিল। যদিও তাদের বড় একটি অংশই হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, নয়ন নিহত হওয়ার ফলে গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। আবার রিফাতের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়েও মানুষকে হতাশা প্রকাশ করতে শোনা গেছে। তারা বলছে, নয়নের মতোই রিফাতের পরিণতি তারা আশা করছিল। কিন্তু তার আত্মীয় প্রভাবশালী হওয়ায় রিফাত এ যাত্রার বেঁচে গেছে। যারা রিফাতের নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তারা আতঙ্কে রয়েছে। তবে পুলিশ প্রশাসন বলছে, রিফাত শরীফের খুনিদের বিষয়ে তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার পর পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন মোবাইল ফোনে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তথ্য জানা থাকলে সেটা পুলিশকে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর সুনাম জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। একান্ত গোপনে পুলিশ সুপারের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা সুমামের আলাপ হয়। তাই দুজনের মধ্যে রিফাত শরীফের খুনের ঘটনার বিষয়ে কী কথা হয়েছে তা জানা যায়নি।
গভীর রাতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কী কথা হয়েছে সে ব্যাপারে পুলিশ সুপার কিংবা এমপিপুত্র মুখ খুলছেন না। ওই ঘটনার দুই দিন পর গত মঙ্গলবার ভোরে নয়ন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। সংবাদমাধ্যমে নয়ন বন্ডের সঙ্গে এমপিপুত্রের ঘনিষ্ঠতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে জেলা ছাত্রলীগ বরগুনায় সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছিল, এমপিপুত্র মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। নয়ন বন্ড তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায় শহরে মাদক কারবার করছে। সেই থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, নয়নের সর্বশেষ তথ্য এমপিপুত্রের কাছেই রয়েছে। মূলত পলাতক নয়নকে ধরতেই এমপিপুত্রের সহযোগিতা নিয়েছিল পুলিশ।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথ গত বুধবার বিকেলে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘রিফাত শরীফ হত্যার পর আমি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যাইনি।’ নয়নের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার বাবা যাতে দলীয় মনোনয়ন না পান সে জন্য আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকর্মী জোট বেঁধে ছিল। তাদেরই একটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে মাদক ও নয়নকে প্রশ্রয় দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিল।’
জানতে চাইলে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গতকাল বিকেলে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘রিফাত হত্যার ঘটনা শুধু বরগুনায়ই নয়, দেশব্যাপী আলোচিত। ওই ঘটনার তদন্তের স্বার্থে অনেক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। তা ছাড়া আমার কার্যালয়টি জনগণের। এই কার্যালয়ে যেকোনো সময় যে কেউ আসতেই পারে। তার মানে এই নয় যে তিনি রিফাত হত্যা মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
এদিকে নয়ন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার আগে সোমবার রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের বাসভবন ও জেলা পরিষদ কার্যালয়ে অভিযান চালায়। ওই অভিযানের সময় চেয়ারম্যানের বাসা থেকে একজনকে চোখে-মুখে কালো কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলছেন, যাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে চেয়ারম্যানের আরেক ভায়রার ছেলে লিশান। আবার কেউ কেউ ধারণা করছেন, রিফাতকেই চেয়ারম্যানের বাসা থেকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
অভিযানের খবর পেয়ে বরগুনার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহের জন্য চেয়ারম্যানের বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযান পরিচালনাকারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বাধা দেন। এমনকি সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতেও অস্বীকৃতি জানান।
অভিযান শেষে ওই রাতেই চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা বাসায় এসেছিলেন। তল্লাশি চালিয়ে তাঁরা চলে যান। তাঁর বাসা থেকে কাউকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়নি বলে চেয়ারম্যান দাবি করেছেন। এমনকি তাঁর ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজীকে পুলিশ কোথা থেকে গ্রেপ্তার করেছে তাও জানেন না বলে এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছেন তিনি।
রিফাতের গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থেই আমরা গ্রেপ্তারের স্থান উল্লেখ করিনি। কারণ রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আরো আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
বরগুনা পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক আরিফ বলেন, ‘আমি বিনা বিচারে হত্যার বিপক্ষে। কিন্তু নয়নের মৃত্যুর পর দেখেছি বরগুনার হাজার হাজার মানুষ উল্লাস করেছে। কেউ কেউ মিষ্টি বিতরণ করেছে। এই আনন্দের নেপথ্যের কারণ রিফাতের প্রতি নয়নের নৃশংসতা। যেটা দেখে নয়নের প্রতি মানুষের ঘৃণা আর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে নয়ন নিহত হওয়ার কারণে তার আশ্রয়দাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। নয়ন নিহত হওয়ার পর যে মানুষগুলো উল্লাস করেছিল, রিফাতের গ্রেপ্তারের পর তারা হতাশা প্রকাশ করেছে। কারণ তারা নয়নের মতো রিফাতের পরিণতি চাইছিল।’
বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, নয়নের গডফাদার কে তা বরগুনার সাধারণ মানুষ জানে। একাধিক মামলায় নয়ন গ্রেপ্তার হয়েছিল। সুতরাং নয়নের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগে তথ্য রয়েছে। সরকার চাইলে নয়নের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাকে আইনের আওতায় আনতে পারবে পুলিশ।
রিফাত প্রসঙ্গে মনির হোসেন কামাল বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের খবরে নির্যাতিতরা আতঙ্কিত। তা ছাড়া অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছে। তবে কারো কারো ধারণা, রিফাতের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তার আরো কয়েক সহযোগী পলাতক। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার পরিণতি নয়নের মতোই হতে পারে।
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘নয়ন বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর একটা পক্ষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কারণ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নয়ন থেকে নয়ন বন্ডের জন্ম হয়েছে। রিফাতের প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। হয়তো এই কারণেই তার পরিণতি নয়নের মতো হয়নি।’(তথ্য সূত্রঃ কালের কন্ঠ)