হিলি দিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টা নয়ন বন্ড
পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করলেও তাদের মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি মাত্র তিনজন। তবে শনিবার বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেছেন, মামলার সব আসামিকে ২ দিনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হবে।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, প্রধান আসামি নয়ন বন্ড দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সীমান্তে রেড অ্যালার্ট থাকায় সে পালাতে ব্যর্থ হয়। তবে পুলিশ বলছে, তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। অপর এক সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করত এ নয়ন বন্ড।
নয়ন বন্ডের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, বরগুনা শহরের ৭নং ওয়ার্ডের বাসায় মাকে নিয়ে থাকলেও নয়ন বন্ডের আদি বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলায়। বরগুনায় জমি কিনে বাড়ি করেছে তার সিঙ্গাপুর প্রবাসী বড় ভাই মিরাজ। নয়ন বন্ডের মামা আ. খালেক ছিলেন বরগুনা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। এই খালেক এক সময় বরগুনা সরকারি কলেজের উচ্চমান সহকারী ছিলেন। তিনিও ছিলেন নয়ন বন্ডের আরেক খুঁটি। বরগুনা সরকারি কলেজে অবাধ বিচরণ এবং ক্যাম্পাসে প্রভাব খাটানোর ব্যাপারে মামা খালেকের প্রশ্রয় পেত সে।
ওই আত্মীয় আরও জানান, ২৬ জুন হত্যার ঘটনার পর নয়ন বন্ড পাথরঘাটার সুন্দরবন এলাকা হয়ে দেশ ত্যাগ করতে পারে ভেবে পুলিশ যখন পাথরঘাটা এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে নয়ন তখন পুরাকাটা ফেরি পার হয়ে আমতলী গলাচিপা হয়ে পৌঁছে গেছে দশমিনায়। সেখানে বুধবার রাত কাটায় সে। এরপর নৌ ও সড়ক পথে ভেঙে ভেঙে চলে যায় উত্তরবঙ্গের জেলা শহর দিনাজপুর।
বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার দিনের প্রথমভাগ পর্যন্ত চেষ্টা চালায় হিলি বর্ডারের চোরাপথ ধরে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এরই মধ্যে সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি হওয়ায় পালাতে ব্যর্থ হয় সে। আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ছিল নয়ন বন্ডের। নিরাপত্তার স্বার্থে এরপর সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সে।
ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলোর কোনো একটাতেই আত্মগোপন করে আছে নয়ন। এছাড়া রিফাত ফরাজীও সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশে পালানোর চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নয়ন বন্ডের বাড়ি যে পটুয়াখালী জেলার দশমিনা থানায় সে ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান বরগুনা সদর থানার ওসি আবীর হাসান মাহমুদ। দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে তার দেশ ত্যাগের চেষ্টার ব্যাপারেও তার কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত নয়ন বন্ড। ধানসিঁড়ি রোড, কেজি স্কুল রোড এবং ডিকেপি রোডের লোকজনও জানতেন এটা। যখন-তখন নয়নের ফোন কলে চলে আসত পুলিশের টহল গাড়ি। পুলিশের মাঠপর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গেও ছিল তার দারুণ সখ্য। এদের সঙ্গে বহু গল্প-আড্ডায় দেখা গেছে তাকে। ডিকেপি রোডের এক বাসিন্দা বলেন, ‘সুনাম দেবনাথের (বরগুনা সদর আসনের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথের ছেলে) লোক হিসেবে নয়ন বন্ডের পরিচিতির কারণে এমনিতেই সবাই তাকে সমঝে চলত। তার ওপর পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে সে। তার কোনো অপরাধে পুলিশকে খবর দিলেও খুব একটা লাভ হতো না।’
সোর্স হিসেবে কাজ করা প্রসঙ্গে বরগুনা কলেজ এবং সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘পাইকারি মাদক বিক্রেতা হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল বিক্রি করত নয়ন বন্ড। যাদের কাছে বিক্রি করত তাদেরই দু-একজনকে মাঝে-মধ্যে ধরিয়ে দিত সে। যার কাছে বিক্রি করত তার ব্যাপারে থানা পুলিশে ফোন দিয়ে তথ্য জানাত। এরপর মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা ওই খুচরা ব্যবসায়ী অথবা সেবনকারীকে ধরে হয় টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিত নয়তো মামলা করে চালান দিত আদালতে। এমন অনেক ঘটনা আছে যে, নয়ন বন্ড থানা পুলিশের কথা বলে ভয় দেখাত বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনকে।’
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে বরগুনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবীর হোসেন মাহমুদ বলেন, ‘আমি এ থানায় নতুন যোগদান করেছি। নয়ন বন্ড পুলিশের সোর্স ছিল এমন কোনো কিছু আমার জানা নেই। আমি তাকে শুধু একজন সন্ত্রাসী হিসেবেই চিনি।’এদিকে শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মামলার সব আসামিকে ২ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমরা বসে নেই। জালের ফাঁস ছোট হয়ে আসছে। আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বাঁচতে পারবে না। আসামিদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসপি আরও বলেন, হয়তো আর ২ দিন সময় লাগতে পারে মামলার সব আসামিদের আইনের আওতায় আনতে। আমি আবারও বলছি, আপনাদের সবার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।
রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হল- চন্দন, হাসান, রকিবুল ইসলাম রিফাত, নাজমুল হাসান ও সায়মন। তাদের মধ্যে ৩ জনকে শুক্রবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন তার বাবা দুলাল শরীফ। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে। সর্বশেষ শনিবার মামলার এজাহারভুক্ত (১১ নম্বর) আসামি রকিবুল ইসলাম রিফাতকে গ্রেফতার করে র্যাব।
নয়ন বন্ডের বিচার চেয়েছেন স্বজনরাও : দশমিনা প্রতিনিধি এইচএম ফোরকান জানান, ঘাতক নয়ন বন্ডের বিচার দাবি করেছেন তার স্বজনরাও। দশমিনায় নয়ন বন্ডের গ্রামের বাড়ির মো. মোশারেফ মোল্লা (সম্পর্কে নয়নের চাচা) বলেন, নয়ন জন্মগতভাবে সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায়নি- রাজনৈতিক ছত্রছায়া তাকে সন্ত্রাসী করেছে। আমরা রিফাত হত্যার বিচারের পাশাপাশি নয়নকে যারা সন্ত্রাসী বানিয়েছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই। একই বাড়ির ইমরান হোসেন মোল্লা জানান, নয়ন বন্ডের বাবার মৃত্যুর পর তার মাকে টাকা-পয়সার জন্য শারীরিক ভাবে নির্যাতন চালাত নয়ন। এ ঘটনায় একাধিকবার স্থানীয় থানায় অভিযোগ করেছিলেন নয়নের মা। ইমরান হোসেন মোল্লাও রিফাত হত্যার কঠোর শাস্তি দাবি করেন।
আলোচনায় সুনাম-দেলোয়ার : বরগুনা শহরের প্রভাবশালী দুই রাজনৈতিক নেতা সদর আসনে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। প্রভাবশালী হওয়ার পাশাপাশি এ দুই আওয়ামী লীগ নেতার দ্বন্দ্বের বিষয়টিও সবার জানা। নৌকার প্রার্থী হয়েও একবার দেলোয়ার হোসেনের কাছে সংসদ নির্বাচনে হেরেছিলেন শম্ভু। আলোচিত এ দুই প্রভাবশালী নেতার মধ্যে চরম বিরোধ থাকলেও বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে নিজেদের সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য বিস্তারে এ দু’জনার কাঁধেই ভর করেছিল নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী। মাদকের পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে বরগুনা শহরের আলোচিত একটি নাম নয়ন বন্ড। বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দীর্ঘদিন জেল খাটার ইতিহাসও রয়েছে তার। এছাড়া নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে থানায় যেসব মামলা রয়েছে তার অধিকাংশও মাদক মামলা। বছরখানেক আগে বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের একটি অংশ প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথের পুত্র সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে সরাসরি মাদক বাণিজ্যের অভিযোগ করে। সুনামের মাধ্যমেই বরগুনা জেলায় মাদকের বিস্তার ঘটেছে বলে দাবি করেন তারা। ২৬ জুনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সুনামই প্রথম নয়ন বন্ডকে ছাত্রলীগ কর্মী বলে প্রচার চালান। পরে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আর মুখ খোলেননি তিনি। এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে সুনাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নয়ন বন্ডকে আমি চিনি না। তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ও নেই। হত্যার সঙ্গে জড়িত রিফাত ফরাজী এবং রিশান ফরাজী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আপন ভায়রার ছেলে। তার (দেলোয়ার) ছত্রছায়াতেই এরা কুখ্যাত সন্ত্রাসী হয়ে উঠে। একবার রিফাত ফরাজীকে আটক করে থানায় নেয়া হলেও দেলোয়ার তদবির করে তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে আমি ও আমার বাবার সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে চাইছে।’
নয়ন বন্ডের মতো রিফাত ফরাজী সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘রিফাত ফরাজী মাদকাসক্ত ছিনতাইকারী ও চোর। ৪-৫ বছর আগেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। বহুবার তাকে ধরে পুলিশেও দিয়েছি। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কোনো অন্যায় প্রভাব আমি খাটাইনি। সেখানে রিফাতের মতো তিন নম্বর আত্মীয় আমার প্রভাব খাটাবে কি করে?’
নয়ন বন্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার (নয়ন) গডফাদার তো সুনাম দেবনাথ। এলাকায় এদের মাধ্যমে মাদক ঢুকছে। এলাকা এবং কেন্দ্রে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য একটি গ্রুপ উঠেপড়ে লেগেছে। তারাই এসব অপপ্রচার ছড়াচ্ছে।’
নয়ন বন্ড গ্রেফতারের গুজব : রিফাত হত্যার মূল অভিযুক্ত নয়ন বন্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং বাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক ফয়সাল আহম্মেদ মুন্না। শনিবার বেলা ১১টা ৭ মিনিটে তিনি এ স্ট্যাটাস দেন। তবে পুলিশ বলছে, নয়ন গ্রেফতারের কোনো খবর তাদের কাছে নেই। ফয়সাল আহম্মেদ মুন্না তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘বরিশালের নথুল্লাবাদ থেকে বরগুনার পৈশাচিক হত্যাকারী নয়ন বন্ড আটক।
যারা এ হত্যাকারীদের আশ্রয় দিচ্ছেন তারাও অপরাধী। রাতে নয় দিনের বেলাতেই ওকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া হোক। যেন সমগ্র দেশের এরকম পিশাচরা সোজা হয়ে যায়।’
সুত্রঃ যুগান্তর