সুপেয় পানির সংকট উপকূলীয় পাথরঘাটায়
চারিদিকে নদ-নদী বেষ্টিত উপকূলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। এই উপজেলার চারপাশে অফুরন্ত পানির উৎস থাকলেও রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের জনজীবন। পানি সমস্যা নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগীতায় পাঁচ শতাধিক পণ্ড-স্যান্ড ফিল্টার (পিএসফ) বসানো হলেও তার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ডায়রিয়া প্রবণ এ উপজেলাটির জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে রয়েছে।
ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানুসহ ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকাগুলোতে প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানি বঞ্চিত।
এর মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটার স্থানও অন্যতম। আন্তর্জাতিকভাবে পানিতে লবণের মাত্রা ৬০০ পিপিএম পর্যন্ত খাবার উপযোগী ধরা হয়। কিন্তু পাথরঘাটার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের মাত্রা তিনহাজার পিপিএম।
বরগুনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী উপজেলার পৌরসভাসহ ৮ টি ইউনিয়নের মধ্যে কাঠালতলী, কালমেঘা পাথরঘাটা সদর, চরদুয়ানী, নাচনাপাড়া ইউনিয়নে ভূপ্রাকৃতিক কারণে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। এই সকল ইউনিয়নের জন্য বিকল্প পানির উৎস হিসেবে ৫৮৯ টি পুকুরে বালুর ফিল্টার (পিএসএফ) বসানো হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে সচল আছে মাত্র ১৩১টি এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দেওয়া আরো ২০টির মত ফিল্টার সচল আছে। বাকি সকল ফিল্টার গুলো একদম পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এছাড়াও এ উপজেলায় পানি সমস্যা নিরসনে ৯০৩ টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও এর মধ্যে ৭৫০ টি অকেজ। এছাড়া গভীর নলকূপ স্থাপন না করতে পারায় বিকল্প হিসেবে রেইন ওয়াটার হারবেস্টিন (বৃষ্টির পানি সরবরাহ) ৩৩৪ টি স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান উপ-সহকারী প্রকৌশলী দোলা মল্লিক।
স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে গভীর নলকূপ থেকে ওঠে লোনা পানি। তাই বাধ্য হয়ে পানির চাহিদা পূরণে ব্যবহার করতে হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ডোবা নালার পানি। এতে করে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা।
উপজেলার হাড়িটানা গ্রামের গৃহবধূ রাহিমা বেগম প্রতিদিন ঠাঠা রোদের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে পাশের গ্রাম কোড়ালিয়া যান পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে। পানির লাইন দীর্ঘ হওয়ায় এক কলসি পানি সংগ্রহ করতে তার চলে যায় একবেলা। পাঁচজনের সংসারে খাবার পানির প্রয়োজন মেটাতে শুধু এ বেলায়ই নয় আসতে হবে আরেকবার। প্রতিদিন এভাবেই সুপেয় পানির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন গৃহবধূরা।
রাহিমা বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন এভাবে পানি সংগ্রহ করতে দিনের অর্ধেকটা সময় চলে যায়। তারপর ঘর গেরস্থলির কাজ তো আছেই। এভাবে কতোকাল যে পানির লইগ্গা মোগো সংগ্রাম করা লাগবে কইতে পারি না।’
শুধু রহিমা বেগমই নয় পাথরঘাটার গোটা উপজেলা জুড়ে রয়েছে এই একই সমস্যা। কেউ পুকুরের পানি দিয়ে সারছেন ঘর গেরস্থলির কাজ। আবার কেউ পুকুরের পানি ফুটিয়েই ব্যবস্থা করছেন খাবার পানির।
এছাড়া ফিল্টার ও নলকূপ নষ্ট থাকায় পুকুর, ডোবানালা ও খাল বিলের পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করায় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ।
স্থানীয় অনেক ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন
‘পুকুর ও ডোবার পানি খাওয়ায় অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। পানির মধ্যে থাইক্কাও মোরা খাওয়ার পানি পাই না।’
এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা ডা. মাসুদুল হক বলেন, পাথরঘাটায় নিরাপদ পানির তীব্র অভার রয়েছে। এতে করে এই সকল এলাকায় খাল-বিল নদী নালার পানি পান করায় টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার মানুষ। এতে করে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে রয়েছে। তাই দ্রুত এই সকল অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যদিকে পৌর এলাকায়ও একই সমস্যা। তাই ডানিডার সহযোগিতায় পৌর এলাকা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে কাকচিড়া ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে মাত্র ১৬০০ টি হোল্ডিংয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
সুপেয় পানির জন্য বরগুনাসহ উপকূলীয় লবনাক্ত এলাকায় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এর কোন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও উন্নয়ন কর্মীদের দাবী এসকল টাকা শুধু মাত্র ঠিকাদারদের পকেট ভারী করার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে। বস্তুত সুপেয় পানির অভাব রয়েই গেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন সংকল্প ট্রাষ্টের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন, বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে কাজ করছেন জিও, এবং এনজিও। এই সব প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে তাদের আর কোনো তদারকি থাকে না। তাই প্রয়োজন দীর্ঘ স্থায়ী পরিকল্পনা। দীর্ঘ মেয়াদে পানি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।
পাথরঘাটাসহ বিভিন্ন স্থানে পণ্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) বসানে হয়েছিলো তা কারিগরি কাঠামো ঠিক না হওয়ায় খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে স্বীকার করলেন পাথরঘাটা উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগে উপ-সহকারী প্রকৌশলী দোলা মল্লিক। তবে এই এলাকায় সুপেয় পানির চাহিদা পুড়নে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলেও জানালেন তিনি