আন্তর্জাতিক নারী দিবসনারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলে স্থানীয় সরকার উন্নয়ন সম্ভব

শফিকুল ইসলাম খোকন
মানব সভ্যতাকে যদি পাখির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে নারী ও পুরুষ হলো একটি পখির দুটো ডানা। একটি ডানা ভেঙে গেলে সভ্যতার পাখি উন্নতির আকাশে উড়তে পারে না। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় উচ্চারণ করেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন, ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সর্বত্রই রয়েছে পুরুষদের পাশাপাশি নারীর সরব পদচারণা। এ উপমহাদেশের মানুষ কি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও ইলা মিত্রের বীরত্বের কথা ভুলতে পারবে কোনদিন? ভুলতে পারবে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার কথা? না পারবো না।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর থেকে দিনটি ঘটা করে পালন করা হতো সমাজতন্ত্রী শিবিরে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক শিবিরে নারী মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণাদায়ক দিন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকে প্রায় সব দেশেই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানবসমাজ কতটা এগোল সে বিশ্লেষণও করা হয় এই দিনে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়নের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি দুনিয়াজুড়ে প্রশংসিত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭। আর এশিয়া মহাদেশে এক নম্বর।
আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজ পর্যন্ত নারীরা স্বাধীনভাবে সমাজের সকল স্তরে পুরুষের পাশাপাশি যতটুকু অবদান/ভূমিকা রাখতে পেরেছে সেগুলোর পেছনে রয়েছে নারীদের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের সামষ্টিক ইতিহাস আর ঐতিহ্য। অবশ্য একথা বিশেষভাবে স্বীকার্য যে, নারীর এ লড়াইয়ে বন্ধুর মতো অনেক পুরুষও তার সঙ্গে সহযোদ্ধাবেশে কাজ করে গেছে, এখনও করে যাচ্ছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে এ বিষয়ের সত্যতা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে নারীরা যেভাবে ঘরে-বাইরের নানামুখী পুরুষতান্ত্রিক চাপ মোকাবেলা করেও পুরুষের পাশাপাশি স্বাধীনভাবে জীবনধারণ করছেন তার জন্য তাকে সমাজ-পরিবারসহ রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত মূল্যবোধের সঙ্গে যে কী ভয়ঙ্করভাবে লড়াই চালাতে হয় তা যে কোনো স্বাধীন আর মর্যাদাবান নারী ও পুরুষের পক্ষেই বোধগম্য। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের নানা ধরনের মূল্যবোধ বা ভাবাদর্শ সর্বদাই নারী-স্বাধীনতা ও অধিকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে খর্ব করেছে যুগে যুগে : আজও করে চলেছে।
আমরা কি অবজ্ঞা করতে পারব মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরপ্রতীক কাকন বিবি ও তারামন বিবির বীরত্বকে? যে দেশের পবিত্র মাটিতে প্রীতিলতার জন্ম, ইলা মিত্রের জন্ম ,বেগম রোকেয়ার জন্ম, তারামন বিবি ও কাকন বিবির জন্ম , যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, সেদেশে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না। হেফাজত কি চায় বাংলাদেশে? নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে? বাংলাদেশকে অন্ধকার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে? বাংলাদেশকে তালেবানি তা-ব- ভূমি, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানাতে? হেফাজতের এসব অবৈধ দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হলে- বেইমানি করা হবে বাংলা ও বাঙালির হাজার বছররের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে। রবীন্দ্র নাথ-নজরুল, লালন ফকির এবং হাছন রাজার অন্তরাত্মার সঙ্গে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ হচ্ছে নারী। তাদের উন্নয়ন কর্মকা-ের বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করা যায় না। ভাবা যায় না সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এ দেশে পোশাক শিল্প হচ্ছে প্রধান রফতানি খাত। এ শিল্প থেকে প্রতিবছর ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে বাংলাদেশ।
নারী আন্দোলন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ দেশের নারীমুক্তির জন্য বেগম রোকেয়া নারী সমাজকে সচেতন হওয়ার জন্য প্রথমে শিক্ষা অর্জনের কথা বলেছেন। তিনি স¦প্ন দেখতেন মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের মাটিতে তারা উজ্জ্বল ভূমিকা রাখবে। লেখাপড়া শিখে পুরুষদের মতো, জজ ব্যারিস্টার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক হবেন পাশাপাশি দেশের শাসনও করবেন। আজ প্রশাসনে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি সংসদেও নারীরা গিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজ নারীরাই দেশ পরিচালিত করছেন, এমনকি যে পেশায় জীবনের ঝুঁকি বেশি সাংবাদিকতায়ও সে সেক্টরেও নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। হয়েছেন সংসদের স্পীকার,ডেপুটি স্পীকার, পাইলট, সংবাদ পাঠ, রিপোর্টিংসহ ক্রাইম রিপোর্টিংও দেখা যাচ্ছে নারীদের। এসব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও পরিপূর্ণতা পায়নি আজও। কিন্তু ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে’ নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সে জন্য মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবিটি এখন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সেজন্য ‘এমপো বাস্তবায়ন ফোরাম বাংলাদেশ’-এর অন্তর্ভুক্ত ২৫টি সংগঠন ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রে, বিভাগে, নগরে, জেলায়, উপজেলায় ও ইউনিয়নে সমমর্যাদায় ১০০:১০০ প্রতিনিধিত্বে নরনারীর ‘গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন’ সুনিশ্চিত করার জন্য লাগাতার ক্যাম্পেন করে আসছে। এছাড়াও ‘আরএস ফাউন্ডেশন’সহ বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং নারীদের পুরুষদের সঙ্গে সমঅধিকারে কাজ করে আসছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়নে পরিপূর্ণভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু নারী কেন্দ্রিক দিবস পালন করলেই হবে না, নারী ক্ষমতায় আসতে হলে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নে আসতে হবে। কেন না, গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের মধ্যে অবশ্যই রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন থাকছে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মধ্যে গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন নাও থাকতে পারে। তার উদাহরণ অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর দিকে নজর দিলেই পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রতি সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষা, স¦াস্থ্য, বাসস্থান, সম্পর্কের মালিকানা, নীতিনির্ধারণ ও শ্রমের মূল্যায়ন, নিরাপত্তাহীনতা, নির্যাতন ও সহিংসতাসহ আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিবেচনায় বাংলাদেশে এখনও নারী ও পুরুষের অধঃস্তন করে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত বেজিং চতুর্থ নারী সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সব ক্ষেত্রে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণ থাকতে হবে নারীর। এক-তৃতীয়াংশ থেকে এখন নারীবাদী সংগঠনগুলো চায় ১০০ : ১০০ প্রতিনিধিত্ব নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণের হার মাত্র ৫.১ ভাগ, হাইকোর্টে ৪৫ জন আইনজীবীর বিপরীতে নারী মাত্র ১জন, বিচারকের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ, সির্ভিল সার্ভিসে ৭.৮৮ শতাংশ নারী এবং নীতিনির্ধারণী পক্ষে তা মাত্র ০.০১২ শতাংশ।’ এখন নারী আন্দোলনের প্রতিফলন হিসেবে পর্যায়ক্রমে নারীর সমঅধিকারের দিকে এগোচ্ছে।
একটা সময় ছিল নারীরা নাগরিক হয়েও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত না। আন্দোলনের মাধ্যমে ভোটাধিকার বাস্তবায়ন হয়েছে। আজ নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশ।৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করে থাকে গোটা বিশ্ব। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা আজ ক্রমে গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।আন্তর্জাতিক নারী দিবসে হোক ‘নারীর গণতান্ত্রিক সমঅধিকারের’ সূচনার দিন। নারীদের দেয়া হচ্ছে সমঅধিকার। এ অধিকার স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য নারীকে আরও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন সাধারণ সদস্য নির্বাচিত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন ৯টি ওয়ার্ডে (নির্বাচনী এলাকায়) বিভক্ত। আবার সংরক্ষিত আসনে ৩ জন মহিলা সদস্য নির্বাচনের স্বার্থে প্রতি তিন ওয়ার্ডকে নিয়ে একটি একটি নির্বাচনী এলাকা গঠিত। প্রতি তিন ওয়ার্ডে একজন মহিলা সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও তাঁর প্রকৃত ক্ষমতা ও মর্যাদা একেবারেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং দুর্ভোগ, কষ্ট ও নির্বাচনী ব্যয় বেড়েছে শতগুণ; এবং তাঁকে প্রায়শই ‘-নিধিরাম সর্দার’ বলে উপহাস করা হয়ে থাকে। অথচ এমপো অনুযায়ী ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী প্রতি ওয়ার্ডে একজন পুরুষ মেম্বার ও একজন নারী মেম্বার নির্বাচিত করা হলে উভয় মেম্বারের ক্ষমতা ও মর্যাদায় সমতা আসত; উভয় মেম্বারের দুর্ভোগ, কষ্ট ও নির্বাচনী ব্যয় কমে যেত; এবং প্রতি ওয়ার্ড কেন্দ্রীক উভয় মেম্বারের প্রতিযোগিতামূলক কর্ম তৎপরতায় গ্রামবাসী অধিকতর সেবা পেতেন। এই কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, দেশের দশ কোটি মানুষ অধ্যুষিত গ্রামীণ এলাকার ৪,৫০৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবশ্যই ভাল হত, এবং তা হলে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের প্রথম ও মডেল কান্টি হবার সুযোগ সৃষ্টি হত। বর্তমান জাতীয় সংসদ একটি যুগোপযোগী ইউনিয়ন আইন প্রণয়নে ও নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে ভাবতে খুবই খারাপ লাগে। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতকাল এই খারাপ লাগাটা সইতে হবে আমাদেরকে?
লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com
পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৮ মার্চ