বরগুনায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণে পুরুষের অনিহা
বিশেষ প্রতিবেদন।। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে বরগুনার নারীরা এগিয়ে থাকলেও এ বিষয়ে অনীহা রয়েছে পুরুষদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের সুফল ও পদ্ধতি নিয়ে নিয়মিত প্রচারের ফলে এ বিষয়ে নারীদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এসব পদ্ধতি ব্যবহারে দিন দিন তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু সেই হিসেবে পুরুষদের অংশগ্রহণ ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। তাদের মধ্যে এখনও জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণে ব্যাপক অনীহা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা এটিকে নারীদের বিষয় বলে মনে করে নারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দায় এড়াতে চান।
এই পদ্ধতি গ্রহণে পুরুষের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরুষের যৌন সক্ষমতা কমে যাওয়া নিয়ে অমূলক ভয় এবং অনাগ্রহই দায়ী। সন্তান ধারণে সক্ষম নারী ও পুরুষদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের সাতটি পদ্ধতি রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, খাবার বড়ি, কনডম, ইনজেকশন, ইমপ্লাান্ট, আইইউডি, টিউবেকটমি এবং এনএসভি। এগুলোর মধ্যে নারীদের জন্য পাঁচটি পদ্ধতি– খাবার বড়ি, ইনজেকশন, ইমপ্লান্ট, আইইউডি, টিউবেকটমি এবং পুরুষের জন্য দু’টি পদ্ধতি– কনডম ও এনএসভি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে জেলায় অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন লক্ষাধীক নারী। আর বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িয়েছে তিন লাখেরও অধিক। একইভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ইনজেকশন ব্যবহার করেছে অর্ধলক্ষাধীক নারী, যা এখন ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৬৯ জন হয়েছে। এছাড়া নারীদের আইইউডি পদ্ধতি গ্রহণকারী ছিলো ৫ হাজার ৪৬১ জন, এটা বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৫ জন। ইমপ্লান্ট ব্যবহারকারী ছিলো ৪ হাজার ২২৩, এখন হয়েছে ১৯ হাজার ৯২ জন।
পরিবার পরিকল্পনার মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শিকারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সরকারিভাবে বিনামূল্যে এসব সামগ্রী বিতরণ করে আসছেন। এর ফলে বরগুনার জনসংখ্যার আধিক্য, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমে আসছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলো লক্ষ্য অর্জন অনেকাংশে নারীদের প্রজনন অধিকার চর্চার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। সকলের জন্য পরিবার পরিকল্পনাসহ যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাই হলো উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাবিকাঠি। তাই সরকার দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এই খাতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নিত্য নতুন কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্দি পেয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তবে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে পুরুষরা।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে খাবার বড়ি এবং কনডম সবসময় নেওয়া যায়। ইনজেকশন তিন মাস পরপর, ইমপ্লান্ট ৩-৫ বছর পরপর, আইইউডি সেবা আট বছর পরপর নেওয়া যায়। এনএসভি সেবা নিতে পুরুষের খুব অল্প সময় লাগে। তেমন কোনও কাটা-ছেঁড়া হয় না। কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষই এই সেবা নিতে চান না। তারা মনে করে যে, এটি করলে তাদের যৌনক্ষমতা হারিয়ে যাবে। এমনকি নারীরাও মনে করেন, তাদের স্বামীর যৌন সক্ষমতা কমে যাবে, তাই তারা স্বামীকে এই পদ্ধতিটি নিতে দিতে চান না।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিউবেকটমি সেবা নিতে নারীদের অপারেশন করাতে হয়। এরপর তাদের রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাদের জন্য আইইউডি সেবাটি সবচেয়ে ভালো। কিন্তু প্রচারের অভাবে নারীদের এই সেবাটি গ্রহণের হার কম। এই সেবার মাধ্যমে আমরা ইউটেরাসে কপার তার পরিয়ে দেই। এতে স্পাম সঠিক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে বাধা পায়। এই সেবা নিলে হরমোনের কোনও সমস্যা হয় না। শিক্ষিত নারীরা বেশি আইইউডি সেবা নেন। প্রচারের অভাবে এই সেবা থেকে বঞ্চিত থাকে অনেকেই।’
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আবদুল মজিদ বলেন, ‘গর্ভপাত করার চেয়ে খাবার বড়ি বা ইনজেকশন নিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা বেশি ভালো। আমরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সন্তান জন্মদানের জন্য কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করি। সেখান থেকে তাদের দুই বছর পর গর্ভধারণের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। একটি গবেষণায় দেখেছি, প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে ৯৯ জনই নিজের ও সন্তানের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দুই বছর পর গর্ভধারণ করতে আগ্রহী থাকেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতি ৩০ জন তিন মাসের মধ্যেই ফের গর্ভধারণ করেন। দুই বছর গ্যাপ দিয়ে সন্তান ধারণ করতে হলে অবশ্যই একজন মাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার দেড় মাসের মধ্যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। এমনিতেই তার দুটি সন্তানের মধ্যে সব মিলিয়ে ৫-৮ বছরের গ্যাপ তৈরি হয়। এটা মায়ের সুস্বাস্থ্য, সন্তানকে ছয় মাস মাতৃদুগ্ধ পান এবং পরবর্তী সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজে দেয়।’ সামাজিক বাধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরাসরি পরিবার পরিকল্পনা সেবার কথা বললে এদেশের অনেক মানুষই তা সহজে গ্রহণ করতে চায় না তাই, আমরা প্রথমে শিশুর স্বাস্থ্য, মায়ের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের স্বাস্থ্যের কথা বলে পরে পরিবার পরিকল্পনার কথা বলি।
বরগুনার সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ জসিম উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের দেশে মূলত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই পুরুষরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে চান না। বেশির ভাগ পুরুষকে এই বিষয়ে বলা হলে প্রথমেই তারা বলে, আমি কেন করব? কোনও পুরুষের দেখা যাচ্ছে পাঁচটা সন্তান আছে, এরপরও সে পদ্ধতি নিতে চায় না। কোনও নারীর দেখা যাচ্ছে সিজারিয়ান দুইটি সন্তান আছে তার জন্য পদ্ধতি নেওয়া কঠিন। তার পদ্ধতি নিতে চাইলে সেক্ষেত্রে স্বামীকে ভ্যাসেকটমি করতে হবে। কিন্তু স্বামী পদ্ধতি নেওয়ার ব্যাপারে দূরে থাকতে চায়। আবার স্ত্রীও দেখা যায় স্বামী কোনও সেবা গ্রহণ করুক, সেটা চায় না। অবশ্য ২/১ জন স্বামীকে দেখা যায় নিজে থেকে আগ্রহ নিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা গ্রহণ করছে। সেই সংখ্যাটা আসলেই খুবই কম। তিনি আরও বলেন, ‘পুরুষদের এই সেবা না নেওয়ার পেছনে কাউন্সিলিংয়ের অভাব, ধারণা ও সচেতনতার অভাব দায়ী। অনেক সময় স্বামী নিজেও পদ্ধতি নেন না, স্ত্রীকেও নিতে দেন না। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে গর্ভপাত করাতে হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে স্ত্রী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। মূলত জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভুল ধারণা থেকেই এই বিপদগুলো ঘটছে।’
এন এ এস / পাথরঘাটা নিউজ